তানবীরা তালুকদার:
মুভিসাইটে সিনেমা দেখার বিরাট সুবিধা হলো, একটা সিনেমা দেখতে দেখতে কাছাকাছি গল্পের বা ঘরানার আরও কিছু সাজেশান এসে জমা হতে থাকবে। আমাদেরকে এতো আদর করে সাজেশান দিয়ে দিয়ে সিনেমা দেখিয়ে ওদের কী লাভ হয় কে জানে! হয়তো পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়ার মতলব।
দু-চারটে লিঙ্কে ক্লিক করলে হাতের ডান পাশে এতো এতো নতুন লিংক জমা হবে, মনে হবে, কী আছে জীবনে, শুধু সিনেমাই দেখি। দেখছিলাম ঋত্বিক চক্রবর্তী আর অপরাজিতা ঘোষদাসের “সত্যি হলেও গল্প”। বেশ অন্যরকম আইডিয়ার ওপর, অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে সিনেমা। তার মাঝেই জমা হওয়া অন্য সাজেশান থেকে বেছে নিলাম স্বস্তিকা মুখার্জীর “টেক ওয়ান” আর হাতে রাখলাম উত্তম-সুচিত্রার “হার মানা হার”। ভাবলাম, “টেক ওয়ান” না হজম হলে অত রাতে আর এডভেঞ্চারে যাবো না, বাঙালির চির পছন্দের নিশ্চিত বীমাতে পদার্পণ করে নেবো।
“টেক ওয়ান” রিলিজ হয় দু’হাজার চৌদ্দ সালে। সিনেমা শুরু করার ত্রিশ মিনিট পর থেকে স্বস্তিকা যত কাঁদে, তার চেয়ে বেশি কাঁদি আমি। কিছুক্ষণ দেখার পর, সিনেমা পজে দিয়ে গুগল করলাম। গুগল করে খানিকটা হতভম্ব আমি। মৈনাক ভৌমিকের পরিচালনায়, তার সঙ্গে এটি স্বস্তিকার তৃতীয় ছবি৷ এক নায়িকার জীবন অবলম্বনে তৈরি এ সিনেমার গল্পটি নিয়ে আলোচনা খুব কম জায়গায় হয়েছে কিংবা আদৌ হয়নি। হয়নি স্বস্তিকার অভিনয়ের মান নিয়েও কোন আলোচনা যদিও এই সিনেমাটি নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছে, যেখানে বারবার এসেছে, ভয়ঙ্কর উত্তেজক দৃশ্যে, খোলামেলা অভিনয়, সাহসিকতার চরম নিদর্শন তুলে ধরেছেন এ নায়িকা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কলকাতার বাংলা এবং ইংরেজি সব পত্রিকাতেই প্রায় একই ধরনের প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। দু’হাজার চৌদ্দ তো অনেক যুগ আগের সময় নয়, সিনেমায় নায়িকাদের খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করাও নতুন কোন ব্যাপার নয়, ভারতে তো অবশ্যই নয়। জিনাত আমান অভিনয় করেছিলেন সত্যম শিভম সুন্দরম সিনেমায় ১৯৭৮ সালে, ১৯৮৫ সালে কিমি কাতকার ছিলেন টারজানের নায়িকা, রেখা অভিনয় করেছেন কামসূত্রতে ১৯৯৬ এ, ২০০৩ এ বিপাশা বসু এসেছিলো তার জিসম সিনেমা নিয়ে আর বিদ্যাবালান অভিনয় করেছেন ২০১১ তে ডার্টি পিকচারে, এরকম লিস্ট আরও বাড়তেই পারে।
তাহলে কি বাঙালিরা নিজেদের মেয়ের বেলায় অতিরিক্ত রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে? পরমা’র রাখীর ক্ষেত্রেও কি সেটা ছিলো?
অনেক ছোট ছিলাম তখন, সেসব আলোচনা বোঝার জ্ঞান ছিলো না। অথচ আমার ধারণা ছিলো, ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালিরা চিন্তা ভাবনায় অনেক বেশি আধুনিক আর ওপেন টু এনি চেঞ্জেস। সিনেমায় স্বস্তিকা’র প্রাণবন্ত চুমু কি বাঙালি বোদ্ধা আর মধ্যবিত্ত দুই প্রজাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো?
হায় খোদা, “টেক ওয়ান” এর মতো একটি অসাধারণ সিনেমার ওপর কী নিদারুণ অবিচার! সিনেমার গল্প, গান, অভিনয় সব চাপা পড়ে গেছে, নায়িকার চুমু আর খোলামেলা শরীরের নিচে। “জাতিস্মর” থেকেই “খোদার কসম জান, আমি ভালবেসেছি তোমায়” মতো অনুভূতি ধারণ করি আমি স্বস্তিকার জন্যে। তাই আমি লিখছি, “টেক ওয়ান” সিনেমায় নায়িকার শরীর বাদে আসলে আর কী কী ছিলো, কিংবা আমি কী দেখেছি!

ক্রাই ওফ আ হেল্পলেস মাদার, হু কান্ট ডিনাই দ্যা ফ্যাক্টস অফ লাইফ এন্ড এট দ্যা সেইম টাইম ফীলিংস ফো হার ডটার। ক্রাই অফ আ গার্ল নেক্সট ডোর, হু ওয়ান্টেড টু বি লাভড, ডিজায়ারড। আ টেল অফ বিয়িং সো রিচ, বিউটিফুল, সাকসেসফুল ইয়েট সো পুওর এন্ড লোনলি। দো দ্যা ওয়ার্ল্ড ইজ ফুল অফ ক্রাউড, শী লিভস ইন দ্যা মোনাস্টিক, সোলিটারি আইল্যান্ড উইথ কিলিং লোনলিনেস, নো ওয়ান টু হাগ, নো ওয়ান টু কিস, নো শোল্ডার টু ক্রাই, নো ওয়ান এরাউন্ট টু টেল আ সিলি স্টোরি। হুমায়ূন আহমেদ বোধহয় এই অনুভূতি থেকেই লিখেছিলেন, “ঘর খুলিয়া বাহির হইয়া জোছনা ধরতে যাই; হাত ভর্তি চান্দের আলো ধরতে গেলে নাই।“
শেষ দৃশ্যে স্বস্তিকার বা দোয়েল মিত্রের আত্মহত্যা দেখতে দেখতে কদিন আগে মাছরাঙা টিভিতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা কিশোর কুমার দাশের ইন্টারভিউ এর কথা মনে পড়লো। তিনি বলছিলেন, দিনের বেলায় তিনি একজন সফল এক্সিকিউটিভ, আর রাতে বাড়িতে এতো একা যে, প্রায়ই তিনি লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আত্মহত্যা করতে চাইতেন। আমি নিজে এক কথায় এর একটি লাইনও এঁকেছি, “বিষন্নতার কাছে আত্মসমর্পণ হলো আত্মহত্যা।“
“টেক ওয়ান” আমার চোখে কোনো সিনেমায় থাকা আবেদনময়ী নারীর গল্প নয়, এ সময়ে এ সমাজে, ঠিক আমার আশেপাশে থাকা, জীবনযুদ্ধে আপাত সফল, সুন্দরী, মিষ্টি একটি দুঃখিনী নারীর গল্প। ডেইলি মোশানে আছে, হৈচৈ এও আছে, খুব ভালো প্রিন্ট, দেখে নিতে পারেন।