দেশীয় পোশাক শিল্পকে বাঁচানো প্রয়োজন (পর্ব -০১)

তানিয়া ওয়াহাব:

আমাদের দেশের পোশাক শিল্পের সোনালী অতীত রয়েছে। সেই প্রাচীনকালের ঢাকাই মসলিন থেকে শুরু করে পরবর্তিতে জামদানিসহ বর্তমান বিশ্বের ফ্যাশন ও লাইফ স্টাইল বাজারের বিখ্যাত অনেক ব্র্যান্ডের পোশাকের প্রস্তুতকারী দেশ আমাদের বাংলাদেশ। আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৬% আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত থেকে।

এতো বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক পুরো পৃথিবীতে রপ্তানি করা ১৮ কোটি মানুষের এই দেশে, আমরা নিজেদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের পরিবর্তে বেছে নেই বিদেশি পোশাক। বিষয়টা দেশীয় উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট মানুষদের জন্য দুঃখজনক এবং হতাশার।

বিদেশি কাপড় বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অনেক গ্রাহকের অভিযোগ –

# বিদেশি কাপড়ের তুলনায় দেশি কাপড়ের দাম বেশি।

# আমাদের দেশে বিদেশি কাপড়ের সমমূল্যে সমমানের দেশীয় কাপড় পাওয়া যায় না।

# আমাদের দেশের পোশাকের ডিজাইন বিদেশি কাপড়ে ডিজাইনের মতো উন্নত না।

বিষয়গুলোর ভেতরে গিয়ে খতিয়ে দেখতে হলে কিছু বিষয় আমাদের জানা দরকার।

প্রথমত আমাদের দেশের কাপড়ের বাজার অনেকটাই দখল করে আছে ভারত, পাকিস্তান, আর চীন। আকাশ সংস্কৃতির এ যুগে আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে ভারত, পাকিস্তানের পোশাকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। টেলিভিশনের মাধ্যমে তারা ভারত বা পাকিস্তানের লেটেস্ট ফ্যাশনগুলোর বিষয়ে আকৃষ্ট হচ্ছেন চরমভাবে। এটা ভারত, পাকিস্তানের বিপণন কার্যক্রমের অনেক বড় একটা সাফল্য বলে আমি মনে করি। খুব সুক্ষ্মভাবে তারা তাদের হাল ফ্যাশনের ধারণা আমাদের দেশের মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে।

উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ভারতের সামনে তাদের এক’শ চল্লিশ কোটি মানুষের বাজারের সাথে আন্তর্জাতিক বাজার যুক্ত থাকায় তারা একই ডিজাইনের পণ্য উৎপাদন করে কয়েক লাখ পিস। সেক্ষেত্রে তাদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায়।

পোশাক উৎপাদনের ব্যাক প্রসেস চাহিদা পূরণ করার জন্য তাদের নিজেদের যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ, কেমিক্যাল বা অন্যান্য আনুষঙ্গিক নিজের দেশেই উৎপাদন হয়। সেক্ষেত্রে তাদের উৎপাদন ব্যয় কম হয়।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের পণ্য বিপণন বিষয়ক কর্মশালাসহ বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ক্ষেত্রে তাদের পণ্য প্রাধান্য পায়।

পক্ষান্তরে, আমাদের দেশের ফ্যাশন হাউজগুলোর পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিক্রয় নিশ্চয়তা না থাকায় একই ডিজাইন তুলনামূলক কমসংখ্যক পণ্য উৎপাদন করতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয় বেশি হয়। কারখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে সমুদয় মেশিন পত্র বিদেশ থেকে চড়া দামে কিনে আনতে হয়।

কাপড়ের ব্যাক প্রসেস প্রক্রিয়ার ব্যবহ্নত সমুদয় রঙ, ক্যামিকেল, খুচরা যন্ত্রপাতি চড়া দামে বিদেশ থেকে কিনে চড়া ট্যাক্স দিয়ে নিয়ে আসতে হয়। শোরুমের ভাড়া তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি। এমন বিবিধ কারণে আমাদের উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক অনেক বেশি পড়ে।

আমাদের দেশের গ্রাহক কলকাতা নিউমার্কেট থেকে একটি পণ্য কিনে সেটার দামের সাথে আমাদের দেশের স্বনামধন্য কোন ফ্যাশন হাউজের পণ্যের দামের সাথে তুলনা করে থাকেন। কিন্তু ভারতের যেকোনো নামি ব্র্যান্ডের পণ্যের মূল্য আমাদের দেশের যেকোনো ফ্যাশন হাউজের চেয়ে অনেক বেশি।

বর্তমান সময়ে আমাদের দেশীয় পোশাক শিল্পের জন্য আরেকটি বড় হুমকি হচ্ছে ঘরোয়া অনলাইন শপ। দেশীয় উদ্যােক্তারা যেখানে কারখানা সেটাপ দিয়ে, শোরুমের অনেক টাকা ভাড়া দিয়ে, শ্রমিক কর্মচারি রেখে, সরকারি ভ্যাট, ট্যাক্সসহ যাবতীয় শর্ত পূরণ করে একটি পণ্য গ্রাহকের জন্য নিয়ে আসে, সেখানে ভারত পাকিস্তানের পোশাক নিয়ে অনলাইন শপ খুলে কোন রকমের সরকারি বিধি নিষেধ না মেনে এরা যদি পাঁচটা পোশাকও বিক্রি করে, সেক্ষেত্রে ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হয় দেশী উদ্যোক্তা এবং উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট সবগুলো মানুষ।

সবার আগে আমাদের প্রয়োজন মানসিকতার আমূল পরিবর্তন। দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ এবং ভালোবাসা। অনলাইন নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা যদি ভারত, পাকিস্তানের পোশাকের পরিবর্তে দেশীয় পোশাক নিয়ে কাজ করেন, সেক্ষেত্রে আপনাদেরও মুনাফা হবে, সে সাথে এগিয়ে যাবে দেশীয় উদ্যোগ।

সরকারের কাছে আবেদন।

দেশীয় উদ্যোক্তা ও উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুব দ্রুত বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

# প্রথমত দেশের বাজারে অবাধে বিদেশি পণ্য বাজারজাতকরণে কঠিন শর্ত এবং উচ্চমূল্যের কর আরোপ করতে হবে।

# সরকারিভাবে দেশীয় উদ্যোগকে দেশ-বিদেশে প্রোমোট করার জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করতে হবে।

# দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে দেশীয় পণ্য বিদেশে রপ্তানির বিষয় প্রাধান্য দিতে হবে।

# বিদেশের বাজারে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য জামদানী ও তাঁতের কাপড়ের বিপুল জনপ্রিয়তা মাথায় রেখে কার্যকরি বাজারজাতকরণ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

# নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের আমদানি ও রপ্তানিতে ভারসাম্য নীতি গ্রহণ করতে হবে।

# দেশীয় উদ্যোক্তাদের মুলধনের সুদের হার কমাতে হবে।

# উৎপাদনশীল উদ্যোক্তাদের ভ্যাট, ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে।

# কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রপ্তানিকারকদের ন্যায় দেশের বাজার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদেরও কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাট রেয়াত সুযোগের আওতায় আনতে হবে।

পরিশেষে এটাই বলতে পারি, কোভিড-১৯ পরবর্তি বিশ্বে বাংলাদেশের দেশীয় উদ্যোগকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন, আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ। নিত্য প্রয়োজনীয় পোশাক শিল্পের জন্য আমাদের দেশের ১৮ কোটি মানুষের এই বিশাল বাজার অনেক বড় একটা আশীর্বাদ। শুধু দরকার দেশের প্রতি, দেশের পন্যের প্রতি আমাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা। আগামী একটা বছর শুধু দেশীয় পণ্য কিনুন, লাখ লাখ শ্রমিকের কাজের ক্ষেত্র নিশ্চিত করুন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.