পুন্নি কবীর:
ফেইসবুক স্ক্রল করতে করতে একটা খবর পড়লাম- ক্লাস নাইনের একটা মেয়েকে তার বর্তমান এবং সাবেক ‘প্রেমিক’ (এই ক্ষেত্রে প্রেমিক বলা যায় কিনা সে ব্যাপারে বিস্তর আলোচনা করা প্রয়োজন) একসাথে ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে খুন করেছে। লিঙ্ক এর নিচে কমেন্টগুলো পড়লাম। অধিকাংশ লোক এই ঘটনায় তিনটা সমস্যাকে হাইলাইট করেছে- ১) এইটুকু বয়সে মেয়েটার অলরেডি ২ টা প্রেম করা, ২) বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক করা ৩) বাংলাদেশের আইনে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা।
আমি মোটেও আশ্চর্য হই নাই।
সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে গবেষণার কাজ করছি বলে আমি এই ধরনের খবর এর নিচে ফেইসবুকের কমেন্টগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। এই প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে ২০১৮ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে ২.৮ কোটি মানুষ ফেইসবুক ব্যবহারকারী, এই সংখ্যা গত দুই বছরে আরও অনেক বেড়েছে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এই সংখ্যার খুব ছোট একটা অংশও যদি একটিভ হয় তাহলে তাদের মতামত/আচরণ বিশ্লেষণ করে সমাজের মরাল স্ট্রাকচার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেয়া সম্ভব।
যৌন সহিংসতার ঘটনায় আমাদের সমাজে নারীকে দোষ দেয়াটা নতুন কিছু না। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার প্রতিফলন দেখা যায়। আমার ধারণা ব্যাপারটা অনেকেই খেয়াল করেন এবং প্রচণ্ড হতাশ হন। এই হতাশা আমাদেরকে যেন ডিসেন্সিটাইজড না করে দেয় সেদিকটা খেয়াল রাখা প্রয়োজন। অনেকে এদেরকে কমেন্টে এসে গালিগালাজ করে, আমারও ইচ্ছা হয়। কিন্তু বিদ্বেষ এখানে কার্যকরি না, কারণ এরা নিছক নারীবিদ্বেষী না। এদেরকে নারীবিদ্বেষী অথবা সম্ভাব্য যৌন সহিংসতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করার চেয়েও বেশি প্রয়োজন আমাদের সমাজকে রেপিস্ট উৎপাদন করার উর্বর খনি হিসাবে চিহ্নিত করা।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ (নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ কমবেশি সবাই) তার সেক্সুয়ালিটি নিয়ে প্রচণ্ড কনফিউশনে ভোগেন। একজন পূর্ণাঙ্গ বয়স্ক মানুষকে তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এক রকমভাবে তার কাম নিবৃত এবং লালন করার জন্য ধাবিত করে, আর অন্যদিকে সমাজ তাকে পদে পদে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভয়ংকর এক সারভেইলেন্সের নিচে তার যৌনতা বিকৃত রূপ ধারণ করে। এখানে ‘লালন’ শব্দটা ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে কামকে ‘নিবৃত’ করার আচরণটা খুবই সমস্যাজনক। ক্ষুধা যদি শুধু নিবৃত করার বিষয় হতো তাহলে মানবসভ্যতা এখনও গুহা-যুগেই থেকে যেত। মানুষ শিকারি থেকে কৃষিভিত্তিক জীবনের সূচনা করে খাদ্যের উৎসের নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে নিজেকে শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের শিখরে নিয়ে এই সভ্যতা অর্জন করেছে। মানুষের প্রবৃত্তির পরিচর্যার থেকেই সব সৌন্দর্যের জন্ম।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে যৌন বিকৃতি সেখানে ধর্ষণ একটা চূড়ান্ত ঘটনা এবং নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জঘন্যতম (নিউ এজের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৩টি রেপের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়, মনে রাখা দরকার অধিকাংশ রেপ কেইস রিপোর্ট হয় না এবং ম্যারিটাল রেপের কোন স্বীকৃতি নেই)। তবে এরকম রিপ্রেসিভ একটা সমাজে বিকৃতির অসংখ্য রূপ আছে। এ ধরনের ঘটনার সংবাদে প্রচুর নারী পাঠকও নারীর দোষকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন, তাদের সংখ্যা যদিও পুরুষের চেয়ে কম (তার অনেক কারণের একটা কারণ বাংলাদেশে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে নারী মাত্র ২৪ শতাংশ)।
নারী প্রকৃতিগতভাবেই পুরুষের তুলনায় কম সহিংস বলে তার যৌন বিকৃতির রূপ তুলনামূলকভাবে কম হিংস্র। কিন্তু সে তার প্রবৃত্তিবিরোধী সমাজে মানিয়ে নিতে গিয়ে কখনও নারীবিদ্বেষী বা কখনও পুরুষবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। মূলত লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই সেক্স বিদ্বেষী হয়ে যায়, কারণ এই বিষয়টি তার পীড়ার উৎস হিসাবে কাজ করে। জীবনের সুন্দর স্বাভাবিক একটা বিষয়কে পদে পদে স্টিগমা দিয়ে পর্যুদস্ত করে বীভৎস রূপ দেওয়া এই সমাজ ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা জরুরি।
২৬ এপ্রিল, ২০২০