নাসরীন রহমান:
ব্র্যাক এর এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, সারাদেশে সোয়া দুই কোটি লোকের ঘরে কোন খাদ্য নাই। চিটাগং এ কালকেও ত্রাণের গাড়ি লুট করেছে অভাবীরা। ক্রমশ এই বিতর্ক আরও জোরদার হচ্ছে, জীবন বড়, নাকি জীবিকা? একটিকে গুরুত্ব দিলে অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়! দুটো একসাথে রক্ষা করা কঠিন!
এই অবস্থায় কোনটিকে টিকিয়ে রাখতে হবে সেই প্রশ্নই এখন সবার সামনে।
পৃথিবীজুড়ে যে আতঙ্ক এখন সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে; সেই কোভিড-১৯ কে সামাল দেওয়ার জন্য প্রায় সবদেশই এখন পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তার মধ্যে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা, লকডাউন প্রধান।
কিন্তু এই লকডাউন দিয়েও থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল! উপরন্তু লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অর্থনীতি, বেকারত্ব বাড়ছে, বিশ্বজুড়ে খাদ্যঘাটতির আশংকা তৈরি হচ্ছে।
খাদ্য সরবারহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। কেউ কেউ দুর্ভিক্ষের আলামত দেখছেন! জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলছে, করোনা মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিতে পারে। প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষপীড়িত হতে পারে, যা হবে বর্তমানের দ্বিগুণ।
এছাড়া আইএমএফ বলেই দিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে ঢুকে গেছে। আর জীবন বাঁচাতে ঘরে বসে থাকার সময় যত দীর্ঘ হবে, অর্থনৈতিক সংকট তত বাড়তে থাকবে।
শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে বেকার হয়ে পরেছে ৫ লক্ষ লোক! দেশে দেশে ভেঙ্গে পড়ছে অর্থনীতির চাকা। তাই স্বভাবতই জীবন না জীবিকা, কোনটি আগে, সেই প্রশ্নটিই এখন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র সুইডেনই লকডাউন প্রথা মানেনি অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও। দেশটি অপেক্ষা করেছে, সোশ্যাল ডিসস্ট্যান্স মেনেছে, বড় বাচ্চাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করেছে, কিন্তু খোলা রেখেছে একেবারে শিশুদের ডে কেয়ার সেন্টারগুলো, কারণ তাদের মা-বাবাদের ছুটি দিতে বাধ্য হবে সরকার। আর ছুটি দিলে জরুরি সেবার কাজগুলো করবে কে? মূলত হার্ড ইমিউনিটি আর অর্থনীতির কথা ভেবেই দেশটির সরকার এরকম সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশের সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত নড়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আবার অনেকক্ষেত্রে লকডাউনও কার্যকর করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে জনগণের অসহযোগিতামূলক মনোভাব, অজ্ঞতা, দারিদ্র্যতার মতো কারণগুলো উল্লেখযোগ্য!
এই অবস্থায় বাংলাদেশে আবারও সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত করা হয়েছে; স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে এতে করে অর্থনীতি আরও ধস নামবে কিনা? লোকের দুর্দশা আরও বাড়বে কিনা? দফায় দফায় সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে আদৌ কি করোনা সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে? সরকারি হিসাবে করোনায় মৃত ১৩১ জন। আর মোট শনাক্তের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৮৯ জন। ডাক্তার এবং নার্সরা সমানে আক্রান্ত হচ্ছে। সারাদেশে এখনও ডাক্তাররা পিপিই পায়নি, হ্যান্ড গ্লাভস পায়নি, এন-৯৫ মাস্ক তো নেই-ই।
এমনিতে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের কারণে নিম্নবিত্ত, দরিদ্র তো বটেই, মধ্যবিত্তের অবস্থাও করুণ হয়ে উঠেছে। সামান্য জমানো যা ছিলো তাই দিয়ে চলেছিল এতোদিন, কিন্তু লকডাউন বাড়ায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে এখন অনেকেই। সামনের দিন কী করে চলবে জানে না কেউ।
বাড়তি লকডাউন যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা!
লকডাউনের যে পূর্বশর্ত ঘরে থাকা, তা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে পূরণ করা আদৌ সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন এখন সবার সামনে। বিশেষত দরিদ্র মানুষকে পেটের চিন্তায় কাজের সন্ধানে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছেই। যদিও কাজ তাদের মিলছে না। ফলে পেটও যেমন চলছে না, তেমনি সংক্রমণের আশংকাও আছে।
এ অবস্থায় অনেকে বলছেন, লকডাউন কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করে অর্থনীতি সচল করার উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা? অনেকে বলছেন, করোনা মানেই মৃত্যু নয়, কাজেই এই ভয়ে পুরো দেশ বন্ধ রাখার মানে কী? না খেয়ে মানুষ মারা গেলে লকডাউন দিয়ে কী লাভ?
এমন বস্থায় দেশে করোনা’র হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেইসব স্থানে লকডাউন কার্যকর করা যেতে পারে কিনা এবং অন্যস্থানে লকডাউন শিথিল করা যায় কিনা ভাবা যেতে পারে।
জার্মানিতে যেমন করোনা-সংকট সত্ত্বেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথে ফেরার উদ্যোগ শুরু করছে৷ ভারতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে লকডাউন চলতে অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলে উঠা যে দূরূহ হয়ে উঠবে বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যেই তার আলামত দেখা যাচ্ছে।
উপরন্তু অনেক বিজ্ঞানী, চিকিৎসকরা বলছেন এভাবে লকডাউন দিয়ে লোকজনকে দিনের পর দিন গৃহবন্দি করে রাখা হলে মানুষের শরীরে করোনা প্রতিরোধী শক্তি গড়ে উঠবে না। বরং লোকজনকে বের হতে দেয়া উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হতে দেড় থেকে দু বছর লেগে যেতে পারে! মানুষ কি সেই পর্যন্ত গৃহবন্দি হয়ে থাকবে? বরং লকডাউন শিথিল করে, আরও বেশি পরীক্ষা, চিকিৎসা সেবা বাড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে এবং অবশ্যই মানুষের আচরণগত পরিবর্তন আনতে হবে এর বিকল্প নেই।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে, করোনা সংক্রমণ ঘটতে পারে এমন আচরণের পরিবর্তনের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর কর্মসূচি নিলে সফলতা পাওয়া যাবে। আচরণগত পরিবর্তনই পারবে করোনার সংক্রামণ কমিয়ে আনতে।
যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বার বার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে এই বলে যে, “করোনা ভাইরাস মহামারী এখনও ভয়াবহ রূপে রয়েছে। লকডাউন তুলে নিলে তা আরও ভয়াবহ রোপে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম এ ঘেব্রেইয়েসাস এ সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, কিন্তু উন্নত দেশগুলো আর উন্নয়নশীল দেশের পরিস্থিতি এক নয়; উপরন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য সমস্যা প্রকট।
এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে ঘরে বসে থাকলে দিন চলবে না।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুর্দশা শুরু হয়ে গেছে; অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক, পত্রিকার হকার, দিন আনে দিন খায় যারা সেই সব শ্রমজীবী মানুষদের খাবারের আশায় পথের ফুটপাতে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
বাড়ছে ভিক্ষাবৃত্তি!
অনেক জায়গায় লকডাউনের কারণে সব বন্ধ থাকায় বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবরও পাওয়া যাচ্ছে; এ অবস্থা চলতে থাকলে সামাজিক জীবনে এর প্রভাব নেতিবাচক হবে বলার অপেক্ষা রাখে না।