চরিত্রহীন কাকে বলে!

অনন্য আজাদ:

‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানের ‘সানি লিওনের চেয়েও চরিত্রহীন করোনার কাছে যুদ্ধবাজরা অসহায়’ শিরোনামে কলামটি আমার চিন্তারাজ্যে অনেকটা বজ্রপাতের ন্যায় ধীরে ধীরে বিজলী ঝলকানির মতোই অতীতের স্মৃতি স্মরণ হতে থাকে।

২০১৪ সালে কোন একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদায় বিশেষ সহকারী হিশেবে অধিষ্ঠিত প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল আমাকে ফোন করে তাঁর লেখা কবিতা শোনাতে থাকেন। পরক্ষণেই তিনি আমাকে গুলশানের ‘সামডাডু’ রেঁস্তোরাতে আসতে বলেন। বিকেলবেলা সেই রেঁস্তোরাতেই প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল পীর হাবিবুর রহমানের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। পীর হাবিবুর রহমান ও আমাকে কিছুক্ষণ বসতে বলে শাকিল সামডাডু রেঁস্তোরার ওপর তলায় যান।

অনন্য আজাদ

সেই সময় পীর হাবিবুর রহমান হুইস্কি ও আমি বিয়ার পান করতে থাকি। পীর হাবিবুর নিজেকে বিশাল বড় উচ্চমার্গীয় ব্যক্তিত্ব বলেই বোধ করে, তা তার কথাবার্তার মাধ্যমে বুঝতে পারি। তিনি আমার বয়স জেনে খুব অবাক হয়ে জানতে চান- আমার সাথে কীভাবে এতো উচ্চ পর্যায়ের মানুষজনের পরিচয়! তিনি আরও অবাক হন যে, মাত্র তেইশ বছর বয়সে আমি কীভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনার করার দুঃসাহস দেখাতে পারি!

তারপর আমরা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে বসে মোবাইল গুঁতোতে থাকি। এক পর্যায়ে পীর হাবিবুর রহমান খুব ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি তার মদ্যপানের ছবি তুলছি কি না? আমি তাকে একাধিকবার ‘না’ বললেও তিনি আমার মোবাইল দেখতে চান। এবং আমার ছবির গ্যালারি দেখে নিশ্চিত হন যে, আমি তার কোন ছবি তুলিনি। তিনি আমাকে বলেন, ‘মদ লুকিয়ে খেতে হয়, কাউকে জানাতে হয় না। মানুষজন চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলবে!‘

সম্ভবত গতবছর পীর হাবিবুর রহমানের মদ্যপানরত অবস্থায় জাঙ্গিয়া পরে নৃত্য পরিবেশনের চমৎকার একটি ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ পায়। মদ্যপান নিয়ে এতো সতর্ক থাকার পরেও কীভাবে ওই ধরনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পায়, তা আসলেই দুশ্চিন্তার বিষয়।

চরিত্র? এই ভিডিওটি প্রকাশ পাওয়ার পরেও পীর হাবিবুর রহমানের চরিত্রে দাগ পরেনি। তিনি বিন্দাসভাবে তার জীবন সেই আগের মতোই কাটাতে পারছেন। কিন্তু একই ঘটনা যদি কোন নারীর সাথে ঘটতো, তাহলে কি সেই নারীর জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারতো? কিংবা একটা নারীকে যেভাবে মাগী ও বেশ্যা এবং খানকি ডাকা হতো, তা কি পীর সাহেবকে ডাকা হয়েছে? কিংবা ডাকা হবে?

চরিত্র? আমাদের সমাজে মিথ্যা বলা চরিত্রহীনতা নয়, বরং সত্য প্রকাশ করাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে তথ্য গোপন করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং সঠিক তথ্য প্রকাশ করাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে লুকিয়েচুকিয়ে মদ-গাঁজা খাওয়া চরিত্রহীনতা নয়, বরং প্রকাশ্যে বলাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে ধর্ষণ করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং ধর্ষণের শিকার নারী চরিত্রহীন। আমাদের দেশে ছেলে শিশুদের বলাৎকার করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং শিশুকামীদের মুখোশ উন্মোচন করাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে মিথ্যে আশ্বাস দেওয়া চরিত্রহীনতা নয়, বরং দ্বিচারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরাই চরিত্রহীনতা।

আমাদের দেশে গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং স্বৈরাচারের সমালোচনা করা চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে নারী নির্যাতন, নিপীড়ন করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং অত্যাচারের ঘটনাবলী প্রকাশ করা করাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামো তুলে ধরাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে হিন্দুদের নামে/ বৌদ্ধদের নামে/ আদিবাসীদের নামে/ নারীদের নামে/ অন্যের নামে ফেইক আইডি খুলে সাম্প্রদায়িক হামলা করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং দোষীদের শাস্তি দেওয়াই চরিত্রহীনতা।

আমাদের দেশে দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ চাল-ডাল-টিন-ত্রাণ চুরি করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং চোর-ডাকাতদের বিচার চাওয়াই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে দুর্নীতি করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং দুর্নীতি বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়াই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে খুন করা, জবাই করা, এসিড নিক্ষেপ করা চরিত্রহীনতা নয়, বরং অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি দাবি করাই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে ভয়ভীতি দেখানো চরিত্রহীনতা নয়, বরং সাহসের পরিচয় দেওয়াই চরিত্রহীনতা। আমাদের দেশে অস্বাভাবিক বিষয়াদি চরিত্রহীনতা নয়, বরং স্বাভাবিক বিষয়াদি মারাত্মক চরিত্রহীনতা।

শেয়ার করুন: