ফাহমিদা খানম:
চেঁচামেচি শুনে রুম থেকে কান খাঁড়া করে বুঝতে চাইলাম আসলে কী হচ্ছে। লকডাউন হবার পর ঘরেই থাকতে বাধ্য হয়ে আবিষ্কার করলাম মা- বাবার একদমই বনিবনা আসলে হচ্ছে না। ঠাস করে চড়ের শব্দ আর সেইসাথে মায়ের কান্নার আওয়াজে বাধ্য হয়েই রুম থেকে বেরিয়েই উনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মায়ের ফরসা গালে আংগুলের দাগ বসে গেছে।
“বাবা আপনি এটা কীভাবে করলেন? মায়ের গায়ে হাত কেন তুললেন আপনি?”
“আহ রাকিন, তুমি রুমে যাও, কিচ্ছু হয়নি”
“আম্মা আপনি চুপ থাকেন, আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি”
“বেয়াদব ছেলে, আমার খেয়ে আমার পরে আমাকে প্রশ্ন করার সাহস কীভাবে হয় তোমার? যেদিন নিজে টাকা আয় করবে, সেদিন প্রশ্ন করতে এসো”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম বাবার কথায়। তারপর জেদ করেই বললাম —
“আর একদিন যদি এই ঘটনা ঘটে, আমি আপনাকে ছাড়বো না বলে দিচ্ছি”
“তোর মাকে আমি খাওয়াই, পরাই – যেদিন নিজে মায়ের দায়িত্ব নিবি, সেদিন আসিস বড়ো মুখ করে কথা বলতে! আর আমার কথা পছন্দ না হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারিস”
“আমি তো স্বেচ্ছায় এই পৃথিবীতে আসিনি, আপনি বাবা হয়েছেন বলে আপনার ভুল ধরাও যাবে না?”
“যেমন গাছ, তেমন তার ফল!”
দাদীর এই কথায় অবাক হলাম না। কিছু হলেই দাদী সবসময়ই এই কথাই বলেন। মা কান্না চেপে রান্নাঘরে গেলেন, আমিও পিছু পিছু রওয়ানা দিলাম –
“কী হইছে অন্তত আমাকে বলেন আম্মা”
“বাসায় কাজের লোক নাই, ঘন্টায় ঘন্টায় চা বানাতে কত আর ভালো লাগে! চুলায় পানি দিয়ে বাথরুমে জামা-কাপড় ধুতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম পানি শুকিয়ে পাতিল পুড়েছে, সেজন্যে শাসন করলো তোর বাবা”
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়ো শাস্তি মনে হয় মায়ের চোখে পানি দেখা — সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা বলে পড়া নিয়ে থাকি আর ফাঁকে বন্ধুদের সাথে এফবিতে আড্ডা দেই – কতো ট্রল যে দেখি! কিন্তু নিজের বাসায় নিজের মাকে এভাবে দেখবো কল্পনাতেও ভাবিনি।
গতকালই সন্ধ্যায় নাস্তা খাবার সময় শুনি বাবা দুই ফুফাকে বারবার বুঝিয়ে বলছে, এই সময়টা ভয়ংকর, সবাই যেনো কাজ ভাগ করে নেয় – একজনের পক্ষে সংসার সামাল দেয়া সত্যিই অনেক কঠিন। একজন মানুষ মুখে বলছে এক, আর কাজে আরেক! একেই বুঝি বলে দ্বিমুখিতা!
রাতে যথারীতি মা খাবার নিয়ে বসেই আছেন – গতকাল ভাতের মাড় গালতে গিয়ে হাতে ফোস্কা পড়েছিল সেটা উঠে গিয়ে জায়গাটা বীভৎস দেখাচ্ছে। অবশেষে বাবা খাবার টেবিলে এসে বললেন—
“দিন দুনিয়ার খবর তো আর রাখো না, ভাইরাস যে কীভাবে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে সব জায়গায়, সেই আপডেট জানার জন্যেই টিভি দেখি”
মা তখন ছোট বোনকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন –
“এসব আপডেট জানেন অথচ বাসার খবরই কি জানেন বাবা? এসব দেখার জন্যে মায়ের হাতে সময় কোথায়?”
থতমত খেয়ে বাবা উত্তর দিলেন –
“এসব খবর জানতে কতটুকুইবা সময় নেয়? আগ্রহ থাকতে হয় বুঝলে, তোমার মায়ের আগ্রহ বলতে কি আছে?”
“বেশ কাল থেকে আমরা সবাই মিলে কাজ ভাগ করে নেবো, মায়ের আপডেট হবার সত্যিই দরকার আছে, যার যার কাজ সেই করবে, যার যার বিছানা সেই গোছাবে, গোসলের পর জামা-কাপড় ধুবে আর খাবারের পর প্লেটটাও”
“তোর মা বুঝি এসব শেখায় তোরে? আমার ছেলে, আর আমি করবো এসব কাজ?”
“মা শেখাবে কেনো দাদী? তুমিই না ফুফুদের এসব বলো সেখান থেকেই জেনেছি, এক বাড়িতে দুই আইন চলবে না”
“বেশ বাড় বেড়েছে তোমার, আমি করবো ঘরের কাজ? এতবড় সাহস তোমার? এইজন্য আমি তোমার পিছনে টাকা –পয়সা খরচ করেছি এসব শোনার জন্যে? ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো বেয়াদব ছেলে”
“বাবা হিসাবে যেটা কর্তব্য সেটা করেছেন তার মানে এই নয় অন্যায় আমি মাথা পেতে মেনে নিবো? এতোদিন কলেজ, কোচিং, ব্যাচে পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে এসব জিনিস আমার চোখেই পড়েনি, এই লকডাউনে আমি উপলব্ধি করতে পারছি কী হবে এসব দিয়ে? নিজের ঘরে অন্যায় মেনে নিলে সারাজীবন আমি হীনমন্যতায় ভুগবো। আপনি বের করার আগে আমিই নারী নির্যাতনের জন্যে পুলিশকে ফোন করে সব জানাতে পারি জানেন?”
বাবা আর দাদী চুপ করে গেলেন – আমিও এভাবে বলতে চাইনি, কিন্তু পরিস্থিতিই আমাকে বাধ্য করেছে। একটা সাহায্যকারী নাই, অথচ পাঁচজন মানুষের কাজ একাই মা সামলে যাচ্ছেন, তবুও সামান্য ভুল করলে ছাড় নাই! নিজেকে কঠিন করলাম –পড়ালেখার চাইতেই এই দুঃসময়ে মাকে সাহায্য করতেই হবে, সেটাই হবে মানবিকতা আর এই অন্যায় আর বাড়তে দেয়া যাবে না। প্রতিবাদ শুরু হোক ঘর থেকেই।
… মানুষ ঘর ঘর করে গলা শুকায়… একখানা ঘর
আর কতখানিই বা আশ্রয় দেয় মানুষকে, যদি
না ঘরের লোক আপন হয়!
—– শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়