সাবিনা শারমিন:
করোনাক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার মঈন অবশেষে চলে গেলেন। তাঁর এই চলে যাওয়াতে কেউ কেউ বলছেন শহীদ, আবার কেউ বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা। আমার কাছে মনে হচ্ছে এসব সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ধাপ্পাবাজি। মনে হচ্ছে অন্যের ঘাড়ে আপনারা কাঁঠাল ভেঙ্গে খাচ্ছেন।
যুদ্ধের জন্য পরিকল্পনা লাগে, প্রশিক্ষিত সৈন্য লাগে, ঢাল তলোয়ার লাগে, লাগে প্রযোজ্য পোশাক, লাগে সুরক্ষা সামগ্রী।সর্বোপরি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য লাগে একজন নেতা। সেই নেতার লাগে কিছু গুণ। সেই গুণটা হচ্ছে তত্ত্বাবধান, সমন্বয় ও প্রণোদনার গুণ, লাগে যুক্তি, লাগে বুদ্ধি, লাগে কৌশল, লাগে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ইচ্ছা। সবচেয়ে বেশী লাগে যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান’এটি বুঝতে পারা। তা এইগুলার মধ্যে আপনাদের ছিলোটা কি?

এখন ঢাল তলোয়ার পোশাক ছাড়া ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের বন্ধুকের ট্রিগারে বুলেটের মতো ভাইরাসের দিকে নিক্ষেপ করে মেরে ফেলার পর আপনারা গালভরা বাকুম বাকুম ডিগ্রি দিতেসেন, শহীদ? বীরশ্রেষ্ঠ? জাতি আপনারে মনে রাখবে? মন ভোলানো এই ‘শহীদ’ ডিগ্রী, গরীবের ডাক্তার এইসব দিয়া করবেটা কী, হ্যাঁ? আরে ভাই, গরীবের ডাক্তার তো নিজেই গরীব হয়ে হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন!
এদেশের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে বাঁচাতে গিয়ে তিনি নিজেই বিনা চিকিৎসায় মরে গেলেন! আবার বলেন গরীবের ডাক্তার! কী হাস্যকর! একজন চিকিৎসকের মূল্য আপনাদের কাছে কতো তুচ্ছ? তাহলে গরীবটা আসলে কে বলতে পারেন?ডাক্তার, প্রশাসন, পিপিই পরিধান করা আমলা, গার্মেন্টস মালিক, শ্রমিক, আমজনতা, নাকি মরহুমের পরিবার? আমার তো মনে হয় সমগ্র বাংলাদেশের সকল পদাধারী লোকজনই এক একজন গরীব ভিক্ষুক। পদ বগলদাবা করে তিনবেলার জায়গায় চারবেলা ভাত খাওয়ার জন্য শ্রমিকের টাকা মেরে এখন আবার শহীদ স্বীকৃতি দেয়ার পাঁয়তারা করতে আসছেন? এই ধরনের শঠতা কি আপনাদের গরীব বানায় না?
ডাক্তারের পরিবারের সদস্যরা কি আপনাদের এই শহীদ পদবী আর ‘মনে রাখা সান্ত্বনা চায়’? ওরা সকলেই তো পেশার দায়িত্বই পালন করতে গিয়েছিলো। তবে তাদের সুরক্ষিত না করে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন? বড় পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত পদকর্তারা কয়েকদিন আগেই বললেন, ‘পিপিই তেমন একটা লাগবে না’। এখন তারাই আবার বলবেন, ডাক্তাররা সম্মুখ যুদ্ধের শহীদ!
যেই পদ কান্ধে নিয়া আপনারা এসব কথা বলেন ডাক্তারদের কাজে পাঠানোর আগে কি আপনাদের সেই পদবী দিয়া বালিশ বানিয়ে সেই বালিশে মাথা দিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? ঘুম থেকে উঠে হিসাব নেন উইকেটে কয়টা ডাক্তার পড়লো?
ডাক্তার মঈনের স্ত্রী এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে জিজ্ঞাস করুক, তিনি কর্তব্য পালনের সময় ডাক্তারদের সুরক্ষার সঠিক পোশাক দিয়েছিলেন কিনা! যদি না দিয়ে থাকেন তাহলে উক্ত মন্ত্রীকে ডাক্তারদের ডাক্তারদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হোক। ডাক্তারদের ‘শহীদ’ বলার আগে তাদের নিজেদের হন্তারক হিসেবে আইডেন্টিফাই করুন।
আমি পদাধিকারী ব্যক্তিদের বলছি, ওদের বাড়িতে গিয়ে একটিবার দেখে আসুন, এখন ডাক্তার মঈনের স্ত্রী শুধুই তার স্বামীকেই চান। ডাক্তার নয়। সন্তানরা তার বাবাকে চায়। ডাক্তার নয়। আপনাদের খেতাব তারা চায় না। যেরকমভাবে ফটো সাংবাদিক কাজলের স্ত্রী এবং সন্তানরা শুধুই তার স্বামী এবং পিতাকে চায়। এটাই বাস্তবতা। একটি পরিবারই মৃত্যু যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়। অন্য কেউ নন।
আমরা না হয় আবার একটুখানি বাংলা টু ইংলিশ ট্রান্সলেশন শিখি। ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা গেলো’ — এর স্থলে এখন নতুন করে শিখি —-
পিপিই আসার পূর্বেই ডাক্তারটি মারা গেলো, তাই না? আপনারা যা করলেন, সব খুব ভালো হলো এখন তাই না?
ও ভাই, একটু হুঁশে আসুন। এটি ভাইরাস। ভাইরাস কোন মানবগোষ্ঠী নয়। তাই এটি মানুষে মানুষে ভূখণ্ড দখলের, ক্ষমতা দখলের যুদ্ধ নয়। এটি মহামারী। এই মহামারী তো পৃথিবীতে যুগে যুগে, কালে কালেই এসেছে, পৃথিবীতে প্লেগ, কলেরা, স্মল পক্স, ব্ল্যাক ডেথ, ইয়োলো ফিভার, বুবনিক প্লেগ, সোয়ান ফ্লু, স্প্যানিশ ফ্লু, বার্ড ফ্লু, এইচআইভি/এইডস এসব প্রকৃতির নিয়মের মধ্যেই পূর্বেও এসেছে, এখনও আসলো, এ যাত্রায় বেঁচে গেলে ভবিষ্যতেও আসবে। আবার এই মানুষই কিন্তু এই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করেই টিকে আছে। টিকে থাকবে। অনেক প্রাণহানির পর মানুষই প্রতিষেধক আবিষ্কার করে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে। করোনা মহামারীকে এই মানুষই একসময় পারবে। সেদিন কিন্তু দূরে নয়। আজকের দিনই ইতিহাস হবে। এটাই মানুষের সৌন্দর্য, জীবনের সৌন্দর্য। প্রকৃতির বিপর্যয়ের সাথে মানুষের উৎকর্ষতা প্রমাণের একটি পর্যায়। যা সঠিক সময়ে অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
এই অপরিহার্য শব্দটির ব্যবহার জরুরি ছিলো সেইদিন, যেদিন ইতালি থেকে ‘ফাক দিস কান্ট্রি সিস্টেম’ বলা ভাইয়েরা দেশে ফেরত এসেছিলেন। তাদের তখন সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারলে ওই ‘ফাক’ শব্দটি হয়তো তাদের উচ্চারণ করতে হতো না। সেদিন তাদের যথাযথ ব্যবস্থাপনায় লকডাউন করে, নিয়ম মেনে, চিকিৎসা দিতে পারলে আজ হয়তো ডাক্তার মঈনের মতো ডাক্তারদের হারাতে হতো না। সবাই একটু অনুভব করুক একজন মানুষকে ডাক্তার হতে হলে কতো শত রাতকে নির্ঘুম করে দিয়ে ভোর হয়ে যাওয়া দেখতে হয়।
জানি হারানোর এই বেদনা এখন বৈশ্বিক। হারানোর যন্ত্রণা সকল পেশাতেই এক। তারপরেও বলবো ডাক্তার না বাঁচলে রোগী বাঁচাবে কে? তারা বাঁচলেই অন্যরা বাঁচবে।
আপনারা দয়া করে নিজের পদের কর্তব্যটুকু একটু করুন। আপাতত শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেন না। আমজনতা আপনাদেরকে খুব ভালোকরেই চেনেন। আর মহামারীকে মহামারী হিসেবেই প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপ নিন।
মহামারী মুক্তিযুদ্ধ বা ইসলামী জিহাদ নয়।