
সীনা আক্তার: ‘সংস্কৃতি’ [Culture] এবং ‘পরিচয়’ [Identity] বহু-বিস্তৃত বিষয়, যা সমাজ বিজ্ঞান- নৃ বিজ্ঞানের স্নাতক, স্নাতকোত্তর এর পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসাবে পড়ানো হয়, উচ্চতর পর্যায়ে গবেষণা করা হয়। বাস্তবতার কারণেই এ বিষয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়। আমি শুধুমাত্র বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী মিতা হকের সম্প্রতি দেয়া সংশ্লিষ্ট মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে অল্প আলোকপাত করতে চাই।
সংস্কৃতির কোন নির্দিষ্ট একক সংজ্ঞা নেই; ‘সংস্কৃতি’ এবং ‘পরিচয়’ বিষয়গুলি চলমান বা গতিশীল প্রক্রিয়া, কোন পরিপূর্ণ চূড়ান্ত বিষয় নয় (Brah, A. 1996) । উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, আমাদের মা-নানীদের সময় অধিকাংশ নারীদের দেখেছি, ঘরে শাড়ি পরতে, কিন্তু এখন তাঁরা ঘরে মেক্সি পরেন, বিশেষ করে শহুরে নারী। সেসময় অধিকাংশ পুরুষ আনুষ্ঠানিক পোশাক হিসাবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন, কিন্তু এখন তাঁদের অনেকেই শার্ট-প্যান্ট বা স্যুট-টাই পরেন। মানে, সেসময় নারী-পুরুষের পোষাক যেমন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ ছিল, একইভাবে বর্তমানেও তাদের পোশাক আমাদের সংস্কৃতির অংশ।
সময়ের সাথে সংস্কৃতি’র পরিবর্তন ঘটে। আমরা বাঙালী/আদিবাসী-বাংলাদেশী। বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, তাই আমাদের সংস্কৃতিতে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব স্বাভাবিক। আমার নানীকে আমি নিয়মিত বোরকা পরতে দেখেছি। আমার মা একসময় বোরকা পরতেন, পরে অপ্রয়োজনীয় মনে করে বাদ দিয়েছেন এবং তিনি সবসময়ই বাঙালি- বাংলাদেশী-মুসলিম। গ্রাম-মফস্বলে আমার নানীর মত অনেক নারীই তখন ঘরের বাইরে বোরকা পরতেন। এমন কি অনেকে রিকশায় যাতায়াতের সময় পুরো রিকশা শাড়ি বা চাদর দিয়ে মুড়ে নিতেন, হেঁটে যাতায়াত করলে কেউ কেউ ছাতা ব্যবহার করতেন নিজেকে আড়াল করার জন্য। এসবই তাঁরা করতেন পর্দা হিসাবে।
ইদানিং অধিক সংখ্যক নারীর মধ্যে হিজাব পরিধানের প্রবণতা লক্ষণীয়। পোশাক সংস্কৃতির এই পরিবর্তন গত কয়েক বছরে সংগঠিত হয়নি, বরং এটা অনেক দীর্ঘ সময়ের ফলাফল। যে কোন দেশের সংস্কৃতিই সে দেশের জনগোষ্ঠীর মতাদর্শ-রাজনীতি-অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত এবং পরিবর্তনশীল (Brah, A. 1996)। ঘটনা পরিক্রমায় আমাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতির কারণে সামাজিক-ভাবাদর্শগতভাবে [Ideological] যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার প্রভাব এখন আমাদের পোশাক সংস্কৃতিতে স্পষ্ট। যেমন, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কারণে আমরা বিশ্বায়নকে স্বাগত জানিয়েছি। ফলে মিডিয়া-ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পশ্চিমা দেশে যাতায়াত বৃদ্ধির ফলে অনেকেই পশ্চিমা পোশাক-পরিচ্ছদে আগ্রহী হয়েছেন, অনেকের আচার-আচরণ-খাদ্যাভাসে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়।
আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায়, আমাদের পোশাক কারখানার উচ্ছিষ্ট বা অতিরিক্ত পোশাক দৃষ্টি আকর্ষক এবং অনেকের কাছে সহজলভ্য হওয়ায় এসব পোশাক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শহুরে অনেক পুরুষ এখন ঘরে লুঙ্গির পরিবর্তে শর্টস পরেন, নারীরা মেক্সি বা কামিজের পরিবর্তে স্কার্ট-টি শার্ট পরেন। ঘরের বাইরে অনেক মেয়েই ডেনিম, শার্ট, লেগিং, স্কার্ট পরেন। এইসব পোশাক এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ এবং অবশ্যই এসব পোশাক যারা পরেন তারা বাঙালী/আদিবাসী-বাংলাদেশী এবং অনেকেই মুসলিম। দেশের একটা বড় অংশ যেমন আমাদের সংস্কৃতির সাথে এই পশ্চিমা পোশাক সংস্কৃতির কোন বিরোধ দেখেন না। একইভাবে অন্য একটা বড় অংশ আমাদের সংস্কৃতির সাথে ধর্মীয় সংস্কৃতি- ‘হিজাব’ এর কোন বিরোধ দেখেন না। আবার কেউ কেউ পশ্চিমা পোশাক বা হিজাবের সাথে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধ দেখেন। এই ভিন্ন মতামত ব্যক্তিগত [Subjective] এবং আপেক্ষিক [Relational]।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণ এবং ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় সমান্তরালভাবে বিদ্যমান। মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন মুসলিম তার নারী আত্মীয়কে হিজাব পরতে উৎসাহিত করবে, এবং সেই নারী ইচ্ছায়/অনিচ্ছায় হিজাব পরতে পারেন, যা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া, স্বেচ্ছায় অনেক নারী ধর্মীয় পরিচিতিমূলক পোশাক এবং হিজাব পরিধানে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে পারেন। আবার অর্থনৈতিক কারণে আমাদের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক-পেশাজীবী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ করছেন। এই প্রবাসীদের মাধ্যমে আরব সংস্কৃতি, মানে মুসলিম সংস্কৃতির আমদানী খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ।
অন্যদিকে দেশের কিছু রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন থেকে ধর্মীয় সংস্কৃতির মতবাদ প্রচার করছেন। এর ফলে উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী ধর্মীয় পোশাকের প্রতি আগ্রহী হয়েছেন, বিশেষ করে নারীদের হিজাব পরিধান।
একটা সময় হিজাব হয়তো বাঙালি সংস্কৃতির অংশ ছিল না। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক কালক্রমে হিজাব যে এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ, এটা অস্বীকার করার কোন কারণ দেখি না।
রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মিতা হকের দৃষ্টিতে হিজাব পরা নারী বাঙালি হতে পারেন না; একইভাবে হিজাব পরা কোন নারী হয়তো মনে করতে পারেন, মিতা হক মুসলিম হতে পারেন না। প্রকাশ্যে কারও পোশাককে নির্দেশ করে এ ধরনের মন্তব্য কারো জন্যই সম্মানজনক নয়। স্বেচ্ছায় নিজের পোশাক নির্বাচন এবং পরিধান করার স্বাধীনতা সকলেরই আছে এবং এর জন্য কাউকে নির্দিষ্ট পরিচিতি এঁটে দেয়া [Labelled] অবমাননাকর এবং নিন্দনীয়। ব্য
ক্তিগতভাবে আমি হিজাব পরিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। তবে যিনি স্বেচ্ছায় হিজাব পরেন তাকে আমি অন্য যেকোনো ব্যক্তির মতই সম্মান দেয়ার পক্ষে। হিজাব বা স্কার্ট পরিধানের কারণে কারও প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বা কটুক্তি কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু [সত্যিকার] স্বেচ্ছায় হিজাব পরিধান বা পরিধানে বাধ্য হওয়া, হিজাবের ইতিবাচক-নেতিবাচক এসব নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, যা অন্য লেখায় আলোচনার দাবি রাখে।
”আমাদের একটি আইডেন্টিটি ক্রাইসিস আছে…আইডেন্টিটি ক্রাইসিসটা এতো বাজে…”, মিতা হক এর এই উক্তি খুবই সাধারণীকৃত [Generalised] একটা মন্তব্য। স্বেচ্ছায় -অনিচ্ছায়, অনেক কারণেই একজন নারী হিজাব পরিধানের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আত্ম-পরিচয় সংকটের জন্য অধিক সংখ্যক নারী হিজাব পরিধান করেন -এ ধরনের ঢালাও চূড়ান্ত মন্তব্য বিতর্ক এবং বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তিনি নিজে যদি আত্ম-পরিচয় সংকট অনুভব করেন তা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গী-অভিজ্ঞতা [Subjective experience] দিয়ে অন্যের বিষয়কে বিচার করাটা অনাকাঙ্ক্ষিত। কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর আত্ম-পরিচয় সংকট নিশ্চিত হতে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজন।
বাস্তবতা হচ্ছে সামাজিক-মতাদর্শ- অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণে আমরা একটা মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছি, যেখানে মেয়েরা শাড়ী-ব্লাউজ, সালোয়ার-কামিজ, ডেনিম-শার্ট-স্কার্ট পরিধান করছেন; আবার অনেকে হিজাব-বোরকা পরছেন। এর সবই এখন আমাদের পোশাক সংস্কৃতির অংশ বলা যায়। বলা হয়, বিশ্বায়ন এবং ব্যাপক প্রচার মাধ্যম কোন নির্দিষ্ট জাতির সংস্কৃতি-পরিচয় এসবের সীমারেখা ভেঙ্গে দিয়েছে। ফলে ‘এটা’ বা ‘ওটা’ কি আমাদের সংস্কৃতি- এই হাহাকার অর্থহীন। প্রায় সব দেশের জনগণ এখন বৈশ্বিক সর্বব্যাপী গ্রামের [Global village] বাসিন্দা, যেখানে দিনে দিনে ‘আমাদের’ এই ধারণা বিলুপ্তির পথে। তাই বাঙালি/আদিবাসী-বাংলাদেশী-ধর্মীয়-বৈশ্বিক সংস্কৃতি সবই আয়ত্ত করে [Negotiate],সহজে সবকিছু ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। এতে কোন সমস্যা নেই, যেমন আমেরিকার নিজস্ব কোন সংস্কৃতি নেই; ব্রিটিশরা গরমে দক্ষিণ এশীয় কারুকাজ করা ফতুয়া পড়ছে এবং তাঁদের ঐতিহ্যবাহী মাছ-আলু ভাজার [Fish & chips] পরিবর্তে আমাদের মুরগির টিক্কা-তরকারি খাচ্ছে, এতে তাঁরা অ-ব্রিটিশ হয়ে যাচ্ছে না।
মিতা হক একজন সঙ্গীত শিল্পী, সংস্কৃতি-পরিচয় এর মত তাত্ত্বিক বিষয়ে তাঁর সঠিক জ্ঞান না থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। আমার ধারণা, তিনি সঠিক জ্ঞানের অভাবেই এধরনের বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তারপরেও কথা থেকে যায়, প্রচার মাধ্যমে তাঁর এ ধরনের উক্তি অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য। স্বাভাবিকভাবেই তার এই মতামত নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সমালোচনার নামে, সংস্কৃতি রক্ষার নামে তাঁকে অসম্মান করা, কটুক্তি করা অশোভন এবং নিন্দনীয়। যেকোনো জাতির পোশাক, খাদ্যাভ্যাসসহ সংস্কৃতির অন্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে তাঁদের আচার-আচরণ-সহনশীলতা। যুক্তি, তথ্য উপস্থাপনের পরিবর্তে কাউকে কুৎসিত ভাষায় অবমাননা করা কি তাহলে বাঙালি সংস্কৃতি!
লেখক পরিচিতি: গবেষক।