কাজী তামান্না কেয়া:
পহেলা বৈশাখ হিন্দুয়ানী উৎসব, এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে ওয়াজকারীরা৷ সরকারিভাবে উৎসবের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই উৎসব পালন করা শেষ করতে হবে বিকেল ৫টার মধ্যে। মানুষের মনে তাই কিছুটা শংকা, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে৷ গত কয়েক বছর আমরা সেই চিত্রটা প্রবলভাবে দেখে এসেছি৷ কেমন করে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাটাকে তিন চার স্তরের ব্যারিকেড দিয়ে একেবারে ছোট করে ফেলে যায়, সরকার মশায় তা হাতে কলমে দেখিয়ে দিয়েছে। যেন এটা কোনো উৎসব নয়, বরং পুলিশ বা র্যাব বাহিনীর মিলিত শো ডাউন। ২০১৩ সালে বিএনপি জামাতের লাগাতার হরতালে আমাদের পুলিশের সাহসী ভূমিকা আমরা দেখেছি। জঙ্গি দমনে সার্থক একটা বাহিনী শুধু পহেলা বৈশাখের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কেন উৎসবটির টুঁটি চেপে ধরেন, কিছুটা হলেও আমরা তা বুঝতে পারি।

আমরা তো জানি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামী মৌলবাদ ভাবধারার লোকজন বসে আছেন। তারা কি বিএনপি, জামায়েত, বা ইসলামী খেলাফতের লোক? মোটেও নয়। তারা আওয়ামী লীগেরই মানুষ। আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে তারা ইসলামকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে স্তম্ভ নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তারা তা বেমালুম মুছে ফেলেছেন মন থেকে। সবকিছুতে ইসলাম খুঁজতে গিয়ে তারা পহেলা বৈশাখকে ‘হিন্দুয়ানী উৎসব’ এর তকমা দিয়ে বসে আছেন। তাদের কাছে বাঙ্গালী নারীর লাল পেড়ে সাদা শাড়ি দেখতে হিন্দু হিন্দু লাগে, হাত ভরা চুরির রিনিক ঝিনিক শব্দ শুনলে কান ঝালাপালা করে, আর লাল রঙের টিপ দেখলে সাক্ষাত জাহান্নামের কথা মনে পড়ে যায়। রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে তাই তারা দিনটাকে যথা সম্ভব ছোট করে ফেলতে চায়, মুছে ফেলতে চায়, বাংলাদেশীদের (পড়ুন বাঙ্গালী মুসলমানের) জীবনের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসবটাকে।
এবার আসুন ঘরের ভেতর তাকাই। আমাদের মা, খালা, চাচীদের অনেকের সংগ্রহেই এখনও সোনা বাঁধানো পলা আছে। তো, এই পলাগুলি কোথা থেকে এলো? দু’চার পুরুষ আগে যে আমরা হিন্দু ছিলাম, এই সোনা বাঁধানো পলাগুলি তারই সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে বাঙ্গালী মুসলমানের ঘরে। তো পলা যদি সংগ্রহে থাকে, লাল টিপ দেখলে অস্বস্তি হবার কারণ কী? বাঙ্গালী মুসলমানের বিয়েতে যে গায়ে হলুদ দেয়া হয়, বিয়েতে মিষ্টি খাওয়ানো হয়, সেই প্রথা এলো কোথা থেকে? বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে নগদ টাকা, কিংবা ফার্নিচার, কিংবা কয়েক ভরি সোনার গয়না দেবার যে চল, সেগুলিই বা এলো কোথা থেকে? এগুলি সবই তো হিন্দু কালচারের অংশ। বাঙ্গালী কালচার বলে কি আলাদা কিছু আছে? নিজকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে চাইলে, আপনাকে হিন্দু কালচার নিয়ে প্রশ্ন তোলা চলবে না। বাঙ্গালী কালচার দাঁড়িয়েই আছে হিন্দু কালচারের উপর ভর করে। এই সত্যটাকে যদি আপনি অস্বীকার করতে চান, তাহলে মরুর শুকনো খেজুর, আর রুটি খাবার প্র্যাকটিস শুরু করুন। যদি না পারেন তাহলে পহেলা বৈশাখটাকে হিন্দুয়ানী তকমা দেবেন না প্লিজ। আপনার যদি মনে হয়, এই উতসবটা আপনার পালন করতে ইচ্ছে করে না, আপনি করবেন না। দয়া করে উতসবটাকে বিতর্কিত করবেন না।
আজকাল কোনো কোনো মুসলমান পরিবারের বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে উপহার না নিয়ে বরং মেয়ের কাবিনের টাকাটা পরিশোধ করে দেন। এটা অবশ্যই ভালো একটা দিক। আবার মধ্যবিত্তের বিয়েতে যে উপহার উঠে, তা গাড়ি ভর্তি করে ছেলের বাড়িতে নিয়ে যেতেও ভুলে যান না। বিয়েতে মেয়ের পক্ষের কাছ থেকে উপহার নেয়া হিন্দু বিয়ের রীতি। বিয়েতে গায়ে হলুদ, মেয়ের পরনে শাড়ি, এগুলিও হিন্দুয়ানী ব্যাপার। আরো খোলাসা করে বললে সারা বছর যে ভাত দিয়ে শাক-মাছ-ডাল খান সেটিও বাঙ্গালী কালচার মানে হিন্দু কালচার, আর টিভি খুলে ‘জীবন মানে জি বাংলা’ সেখানেও সেই হিন্দুয়ানী ব্যপারই দেখানো হয়। এত এত হিন্দুয়ানী ব্যাপার স্যাপারের মধ্যে আপনি কোনটা পালন করবেন আর কোণটা ফেলে দেবেন, তা কীভাবে ঠিক করবেন? কয়টা রাখবেন আর ফেলবেন? বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলে আগে যেখানে মিষ্টি খাওয়ানো হতো, মুসলমানের বিয়েতে এখন সেখানে খোরমা খেজুর খাওয়ায়। আচ্ছা সারা বছর মিষ্টি খাওয়ার বদলে তো আপনি খোরমা খেজুর খাচ্ছেন না, তাহলে মুসলমানিত্ব ফলাতে গিয়ে বিয়ের অতিথিদের মিষ্টি খাওয়া থেকে বঞ্চিত করে শুকনা খেজুর খাওয়ান কেন? এভাবে না হয় ধর্ম রক্ষা, না হয় কালচার রক্ষা। তার চেয়ে বরং মেনে নিন, আপনি-আমি-আমরা বাঙ্গালী, এই বাংগালিত্ব ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি কালচার।
আমরা যারা মিলেনিয়াল মানে গত শতাব্দীর শেষভাগে জন্মেছি, আমরা অনেক বেশী স্বাধীনচেতা। নিজের উপার্জন নিজে করে খেতে ভালবাসি, নিজের একটা পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাই। সারাবছর তাই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাঁটি। আমাদের জীবনে একটু বিনোদনের দরকার আছে। নিজ সংস্কৃতির এই দিনটির জন্যে আমরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকি। যারা দেশের বাইরে থাকি, সব কাজ ভুলে নিজেদের সংস্কৃতি এই দিনটিকে পালন করতে চাই। প্রিয়জনের হাত ধরে ঢাকের তালে তালে মুখোশ পরে হাঁটতে চাই, গালে মুখে নকশা এঁকে পৃথিবীকে বলতে চাই, আমাদের নিজেদের একটা সংস্কৃতি আছে, আমরা শেকড়হীন নই। আমাদের একটা জাতিসত্ত্বা আছে, সে সত্ত্বার নাম বাঙ্গালী জাতিসত্ত্বা।
আমাদের এতো আকাঙ্ক্ষার দিনটাকে হিন্দুয়ানী তকমা দিয়ে নষ্ট করবেন না, প্লিজ। আগামী কমপক্ষে তিন বছর পহেলা বৈশাখ পড়বে রোজার মধ্যে। তখন এমনিতেই দিনটা অনাড়ম্বরভাবে পালন করা হবে। এই ফাঁকে ওয়াজিরা বাঙ্গালীর উৎসবকে হিন্দুয়ানী উৎসব বলে প্রচার করবে। ওদের কথা আমরা কানে নিতে চাই না। কিন্তু আপনারা যখন এই উৎসবকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলেন, আমাদের আসলেই আর দুঃখ লুকানোর জায়গা থাকে না। আপনারা তো আমাদের দূরের কেউ নন- আমাদের মা, বাবা, পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, কিংবা প্রতিবেশী। আপনাদের নিয়েই আমাদের জীবন। আমরা সবাইকে নিয়েই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দিনটাকে পালন করতে চাই। জানেন তো, শোক একা পালন করা যায়, উৎসব একা পালন করার নয়।