উইমেন চ্যাপ্টার: ছাত্রীর সঙ্গে ‘অশালীন’ আচরণের অভিযোগে এবার আলোচিত হয়েছে দিনাজপুর জিলা স্কুলের এক শিক্ষক। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তবে অভিযুক্ত শিক্ষক তসলিম উদ্দিন এ ঘটনাকে তার বিরুদ্ধে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছেন।
ঢাকায় ভিকারুননিসা স্কুলের পরিমল জয়ধর, কুষ্টিয়ার হেলাল উদ্দিন পান্নার পর এবার তসলিম উদ্দিন। বিভিন্ন মিডিয়াতে এভাবেই আসছে খবরটা, পরিমল, পান্নার পর এবার তসলিম। কিন্তু তাকে মাত্র গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অভিযোগ এখনও প্রমাণ হয়নি, কি করে সাংবাদিকরা একটা উপসংহারে চলে আসতে পারলেন যে, একই পথে তসলিমও হেঁটেছেন!
ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু জানি, তাতে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেই সে অভিযুক্ত হয়ে যায় না। যেমন কাউকে পুলিশে ধরলেই তাকে গ্রেপ্তার হওয়া বলে না, বা আসামী বলে না। যতক্ষণ না তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা তাদের নামের পাশে কোন বিশেষণই ব্যবহার করতে পারবো না। জেন্ডার সংবেদনশীলতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-আন্দোলনের কারণে এখন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েদের নাম-ঠিকানা-ছবি ব্যবহার করি না (যদিও কোন কোন অতিউৎসাহী মিডিয়া হাউস সেই নিয়মের তোয়াক্কা করে না)। সেইরকমই হওয়া উচিত একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও। একজন ব্যক্তি দোষীসাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তার ছবি বা নাম-ঠিকানা ছাপানো খুবই গর্হিত একটা কাজ। যেকোনো কারণে পরে যদি তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ না হয়, তখন এই লজ্জা কি দিয়ে ঢাকবেন সেই লোক?
পরিমল জয়ধর নিজে স্বীকার করেছেন, তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে, তার কম্পিউটার ঘেঁটে এসব অভিযোগের পক্ষে যুক্তিপ্রমাণ সব মিলেছে, কুষ্টিয়ার ক্ষেত্রেই তাই। কুষ্টিয়ার সেই শিক্ষকের নানা অপরাধের নথিপ্রমাণ এখন জনতার হাতে হাতে। প্রশাসন মোটেও সতর্ক ছিল না বলেই আজ এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। তাছাড়া সামাজিক কলংকের কথা যদি ছেড়েও দিই, উঠতি বয়সী কিশোরদের হাতে সেইসব অপরাধের ভিডিও চিত্র চলে যাওয়ায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েগুলো একই শহরের বাসিন্দা হওয়ায় বিষয়টি কতটা ভয়াবহ, বুঝতে নিশ্চয়ই কারও অসুবিধা হওয়ার কথা না। সুতরাং এ দুটি ঘটনায় অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তিই একমাত্র কাম্য।
এবার আসি দিনাজপুরের শিক্ষক তসলিমের প্রসঙ্গে। ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্রীর অভিযোগ, পড়ানোর নাম করে বাসায় ডেকে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালান ওই শিক্ষক। মেয়েটির চাচা এ ঘটনায় নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছেন। শিক্ষকের ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়।
আমরা সাংবাদিকরা কি একবারও ভেবেছি, ওই শিক্ষকেরও একটি বক্তব্য থাকা উচিত? কিন্তু কি সেই বক্তব্য? তিনি বলেছেন, এটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। সাংবাদিকদের তসলিম জানান, তার ওই ছাত্রী ফোন করে ঈদের সালামী চেয়ে তার বাসায় আসতে চাইলে তিনি বুধবার বিকালে কোচিং সেন্টারে আসতে বলেন। পরের দিন সে কোচিং শুরুর দশ মিনিট আগে আসে।
‘সে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে এবং তাকে সন্তানের মতোই মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে একশ’ টাকা ঈদের সালামী প্রদান করি। এ সময় ঘরে আমার স্ত্রীও ছিল’, বলেন তিনি।
এ ব্যাপারে তসলিম উদ্দিনের স্ত্রী জেসমিন আক্তার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ছাত্রীটি তার সামনেই শিক্ষককে ঈদের সালাম করে এবং সালামীর টাকা নিয়ে কোচিং ক্লাসে চলে যায়।
তসলিম এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তও দাবি করেছেন।
তাহলে আমরা কি কোন সিদ্ধান্তে চলে আসার আগে কালক্ষেপন করতে পারতাম না? আসল সত্যটা উদঘাটিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম না?
রিপোর্টিংয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, নারী নির্যাতন দমন আইন অজামিনযোগ্য হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই এর বরখেলাপ হয়। সব ঘটনা সত্য নয়, কিছু ঘটনা থাকে প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে। এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি আমি, যেখানে প্রতিবেশিকে জায়গা-জমি নিয়ে ফাঁসাতে নিজের স্ত্রীর গায়ে, সন্তানের গায়ে এসিড ঢেলে দিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেই মামলায় সারাজীবনের মতো জেল খাটছে সেই নিরপরাধ প্রতিবেশি। নারী নির্যাতন দমন আইনেও হরহামেশাই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এখন আইনটি সংস্কারে নড়েচড়ে বসেছে, খসড়াও তৈরি হয়ে গেছে। এটা একটা ভাল পদক্ষেপ, আমি বলবো।
সাংবাদিকতার কথা বলছিলাম, এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অনেক বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। প্রতিটি ঘটনাকে সন্দেহজনক ধরে নিলে কিছুটা রেহাই পাওয়া সম্ভব এই ভুলগুলো থেকে।
ধরেই নিলাম শিক্ষক তসলিম ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছেন, প্রমাণ হলে তার শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু যদি প্রমাণ হয় যে, তিনি তা করেননি, তখন? আজ যে তার নাম-ধাম, ছবি সব ছাপিয়ে দেওয়া হলো, তার মান-সম্মান (নিরপরাধ প্রমাণ হলেই কেবল) ভূলুণ্ঠিত হলো, তার কি ফেরত পাওয়া যাবে?
সাংবাদিকতায় নৈতিকতা, রীতিনীতিগুলো পড়ে নেওয়ার সময় এসেছে বোধকরি।