সুপ্রীতি ধর:
রাত পৌনে ১২টার সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় নাকি বিজেএমইএ প্রেসিডেন্ট রুবানা হক বলেছেন, ‘শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার সময় সাধারণত মাসের সাত কর্মদিবস, যেটা ১০ তারিখে শ্রমিকরা পান। তবে প্রথমত, কোনও ব্যাংক এখন টাকা দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, নেগোশিয়েটিভ করতেও সময় লাগবে (৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ পেতে)। সেক্ষেত্রে ১০ তারিখের যায়গায় ১৫ তারিখ হয়, হবে। তবে মার্চ মাসের বেতন প্রতিটি শ্রমিক পাবেন, এই নিশ্চয়তা দিতে পারি’। শ্রমিকরা যে যেখানে আছেন, সেখানেই যেন অবস্থান করেন, তা তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে বলে জানিয়েছেন।
তো রুবানা হক, এই যে আপনি বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর সময়টাতে সরকার নির্দেশিত লকডাউন অমান্য করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন, আর জীবন-জীবিকার দ্বন্দ্বে থাকা দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষগুলো জীবনের পরোয়া না করে শুধুমাত্র জীবিকা রক্ষার্থে পায়ে হেঁটে কয়েকশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিল, তার দায় কি নেবেন আপনি? আপনি তো কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স শব্দগুলো বোঝেন, মানেন। কারণ আপনি শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু গতকালকের ছবিগুলো দেখেছেন কীভাবে শ্রমিকরা ঢাকায় এসেছে? কোথাও ওইসব গালভরা শব্দের টুটোফাটাও ছিল? যখন সমালোচনা শুরু হলো চারদিক থেকে, তখন আপনাদের টনক নড়লো, দিলেন কারখানা বন্ধের নোটিশ। এখন এই যে শ্রমিকেরা কেউ কেউ সবেই পৌঁছেছিল ঢাকা শহরে, অধিকাংশই তখনও পথে ছিল, ওরা কি তখন এবাউট টার্ন করেছে? যে ‘খুশিতে’ ওরা ঢাকার পথে আসছিল, সেই ‘খুশিতেই’ কি ওরা ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ ডেরায়?

ওরা তো শ্রমিক, ওরা আপনাদের অধীনে কাজ করে উদয়াস্ত শ্রম দিয়ে, সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। কিন্তু ওদের এই কাজের বিনিময়ে যে টাকা আপনারা মুনাফা লাভ করেন, তাতে আপনারা কীভাবে চলেন, তাতো আপনাদের রোশনাই দেখেই আমরা অনুভব করতে পারি। এই মানুষগুলোকে পথে নামিয়েছেন আপনারা, ওদের না ঢাকা, না বাড়ি, মাঝপথে রেখে এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করছে পুলিশ বাহিনী। বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেন আপনারা, মিজ রুবানা?
রুবানা হককে বলছি, আপনি সুন্দর করে কথা বলেন, সুন্দর পরিবেশে থাকেন, ভালো ভালো খাবার খান, কিন্তু কাজগুলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে সুন্দরভাবে করতে পারেন না কেন? আপনাদের কাছে যারা ‘ঊনমানুষ’, তাদের কথা আপনারা যারা ‘মানুষ’ বলে নিজেদের দাবি করেন, তারা কেন ভাবেন না? আজকের ছবিগুলো দেখার পর আপনি কি খেতে পেরেছেন? ঘুমাতে পেরেছেন? খুব জানতে ইচ্ছে হলো আমার।
সরকার যেখানে ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ালো, দেশজুড়ে গণপরিবহন বন্ধ হলো, এমনকি মসজিদে মসজিদে মুসুল্লীদের নামাজও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছিল, সেখানে কোন সিদ্ধান্তে আপনারা কারখানা খোলার নির্দেশ দিলেন? আর তা শুনে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার আশায় তেলাপোকাসম মানুষগুলো গাড়িঘোড়া না পেয়ে হেঁটে রওনা দিয়ে দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে! এটা জানতেন না আপনারা যে এমনটিই ঘটবে?
আপনাদের চোখে এই ‘নির্বোধ জীবগুলো’ তো আপনাদের টাকা এনে দেয়, আপনাদের বড়লোক বানায়, আপনারা তখন দামি গাড়ি ও আলিশান বাড়িতে বসে ওদের মৃত্যুমুখী পদযাত্রা দেখেন!
আপনারা নিজেরাই লকডাউন মানলেন না। সারা দুনিয়ার জন্য পিপিই বানাতে হবে, আদেশ পেয়েছেন। গত দুদিন ধরে বিশ্বনেতাদের টুইট পড়ছিলাম, তাদের পিপিই চাই, গ্লভস চাই, মাস্ক চাই, ভেন্টিলেটর চাই। ভালো কথা। আপনারা সেই চাই চাই পূরণ করতে চান, কারণ এটাই ব্যবসার মোক্ষম সময়। সারাবিশ্ব আজ আপনাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। এমন অসময়ে অন্য দেশগুলো তাদের জনগণকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে মুনাফা অর্জন করার আগে কয়েকশ বার ভাববে। কিন্তু আপনারা সেইসব ভাবাভাবির ঊর্ধ্বে। কারণ আপনাদের মেরুদণ্ড জায়গা মতোন নেই, নেই জবাবদিহিতাও। সরকারের কাছ থেকে নাকি কান্না কেটে কেটে ৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছেন। যদিও চেয়েছিলেন প্রণোদনা হিসেবে, যাতে ফেরত না দিতে হয়। কিন্তু সরকার দিল ঋণশর্তে, তাও নামেমাত্র। কিন্তু সেটুকুও আপনাদের সইলো না।

আপনাদের মতোন পোশাক শিল্পের মালিকদের দেখে তো মনে হয় না এটা এতো নড়বড়ে এক খাত। যে রপ্তানিমুখী খাত থেকে একটা দেশের এতো এতো উন্নয়ন হচ্ছে, সেই খাতের শ্রমিকেরা কয়েকটা দিন কাজ না করলেই আপনারা তাদের আর বেতন দিতে পারেন না, সরকারের কাছ থেকে নিয়েও তা এডজাস্ট করতে পারেন না। এখন বলছেন, মার্চের বেতন হয়তো দিলেও দিবে, কিন্তু ….। শ্রমিকরা এই ভয় থেকেই তো রাস্তায় নেমে পাড়ি দিয়েছিল এতোটা পথ। করোনা ভাইরাসের চেয়ে তাদের ভয় আপনাদের মতোন রক্তচোষা ভাইরাসদের।
যে ভাইরাস পোশাক শ্রমিকদের ‘তেলাপোকা’র মতোন পিষে মারতে থাকে অনবরত। কারখানায় আগুন লাগিয়ে মারে, ভবনে ধস সৃষ্টি করে মারে, ভাতে মারে, প্রাণে মারে, আজ রাস্তায় মারছে।
সারাবিশ্ব এখন করোনা-পরবর্তি সময়ে মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো অনেক ছাড় দিয়ে, অনেক বিকল্প ব্যবস্থা করেই হয়তো এই মন্দা কাটানোর চেষ্টা করবে। তারা করোনা সময়টাকে যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছে, আর এতেই জনগণ সরকারের সাথে হাত মিলিয়েই সব মেনে নিয়েছে। সরকারের অভিভাবকত্বের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেই।
কিন্তু আমরা তো দুর্ভাগা জাতি। চীনের সংক্রমণের পর থেকে দীর্ঘ সময় পেলেও সরকার স্বীকারই করলো না যে তাদের কোন প্রস্তুতি নেই। অথচ এটা স্বীকার করে নিলেই সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে যেতো কাজে। সবাই হাতে সময় পেতো পূর্ণ প্রস্তুতির। আপনারা, ব্যবসায়ীরাও তখন পূর্ণোদ্যমে পিপিই, মাস্ক, গ্লভস বানিয়ে ফেলতে পারতেন, যেহেতু আমরা পোশাক খাতের দেশ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রথম থেকেই সারাবিশ্বের পাশেই দাঁড়িয়ে যেতে পারতাম। ফলে আমাদের যেমন থাকতো অর্থ, তেমনি প্রস্তুতিও। তাহলে আজ আপনাদের এই ‘ঊনমানুষদের’ নিয়ে দিনভর বান্দর নাচটা দেখতে হতো না আমাদের।
তারপরও যখন আপনারা জানলেনই যে এই সংকট মুহূর্তে কিছু অর্ডার আপনারা পেয়েছেন, সেইক্ষেত্রে আপনারা কি পারতেন না শ্রমিকদের বাড়ি থেকে আনার ব্যবস্থা করতে? শ্রমিকদের বাড়ি থেকে আনার খরচ তো খুব বেশি হওয়ার কথা ছিল না। শ্রমিকরাও খুশিমনেই নিজের কাজে ফিরে আসতে পারতো। এতে করে শ্রমিকদের মনে আপনাদের প্রতি যে শ্রদ্ধাটুকু জন্মাতো, তা দিয়ে আপনারা দ্বিগুণ-তিনগুণ কাজ আদায় করে নিতে পারতেন। কিন্তু এই সামান্য খরচটুকুই করতে পারলেন না, আবার আপনারা দেবেন তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা? পোশাক কারখানার মালিকরা এতো স্বেচ্ছাচারী হন কী করে? জনগণের করের টাকায় কত রকমের প্রণোদনা সুবিধা আপনারা সরকারের কাছ থেকে নেন, এবং কীভাবে সেগুলো খরচ করেন, সেটা একটু মনে রাখবেন।

এখন থেকে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ ঝুঁকি ভাতা দিতে মালিকদেরকে বাধ্য করা উচিত। রপ্তানি আদেশ বাতিলের আজাইরা গল্পগুলো শোনাতে আসবেন না। সরকারের কাছ থেকে ‘প্রণোদনা’ নেওয়ার কৌশল হিসেবেই এখন এই শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন করা হয়েছে, দেশের জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। এই বিপদজনক খেলায় গরীব শ্রমিকরা দাবার ঘুঁটি মাত্র; তারা বাঁচলো কী মরলো, তাতে কার কী আসে যায়!
এখানে কয়েকটা দাবি রেখে যাচ্ছি আমরা সকলে মিলে –
রাষ্ট্র ঘোষিত ছুটির মধ্যে কার হুকুমে গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের শত শত মাইল হাঁটিয়ে ঢাকায় আনলো?
| এখন আবার বিজিএমইএ থেকে কেন বলা হলো- ১১ তারিখ পর্যন্ত ছুটি?
| নতুন করে প্রণোদনা পেতে মালিকরা একাজ করেছে সেটা সরকার জানে না এ হতেই পারে না।
| দরিদ্র অসহায় শ্রমিকদের নিয়ে এই নির্মমতা কেন হলো সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।
———
(১) ঢাকায় আসা সকল শ্রমিকের ১১ তারিখ পর্যন্ত নিরাপদ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
(২) মার্চের বেতনসহ ঢাকায় আসার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
(৩) একজন শ্রমিকও যেন ছাঁটাই না হয় সরকারকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
উল্লেখ্য, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে প্রথমে দেশজুড়ে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দশদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় সেই ছুটি বাড়িয়ে এপ্রিলের ১১ তারিখ পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে গার্মেন্টস সেক্টর ছুটি বাড়ায়নি। তারা শ্রমিকদের জানিয়েছে ৫ তারিখেই চাকুরিতে যোগদান করতে হবে। শ্রমিকদের আসতেই হবে। এদিকে গণপরিবহন বন্ধ। তাই চাকুরিতে যোগদানের জন্য শ্রমিকদের প্রায় মিছিলের মতো করে হেঁটে ঢাকার দিকে আসার চিত্র ছিল আজ দিনভর।