করোনার আয়নায় আমরা

ফারহিম ভীনা:

প্রিয় পৃথিবী আজ অসুস্থ, খুব অসুস্থ, দেশ-মহাদেশের মানচিত্র ছাড়িয়ে নেমেছে অতলান্তিক বিষাদ। আত্মঘাতী বসন্তের দিন নিয়ে গেছে কত মানুষের জীবন। পৃথিবীর মহাপরাক্রমশালী মানুষের সাথে আজ যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু – জ্যামিতিক হারে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, একের পর এক লক ডাউন হচ্ছে দেশ।

জীবন মহা মূল্যবান হয়ে ওঠে যখন মৃত্য শংকা আসে –আমরা শংকিত, কিন্তু একইসাথে কী বিস্মিত নিজের চেহারা দেখে| করোনা হটাৎ আমাদেরকে চিনিয়ে দিয়েছে, এই জীবাণু হয়ে উঠেছে আয়না – আমাদের প্রতিবিম্ব ধরা পড়েছে ঐ ক্ষুদ্র জীবাণুর আয়নায়। সরকার ঘরে অবস্থানের জন্য ছুটি দিয়েছে, খুব স্পষ্টভাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মহোদয় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন। করোনা রোগ বিস্তার রোধ করার জন্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত, তাও স্পষ্ট ভাষায় বলা হলো। কিন্তু আমরা নাগরিকরা ঈদ আনন্দে গণপরিবহনে বাড়ি চললাম। সরকার গণপরিবহন বন্ধ ঘোষণা করেছে। অতি উত্তম সিদ্ধান্ত – কিন্তু আমরা নাগরিকরা যে কোনোভাবে ঢাকা ছাড়ার উপায় খুঁজে নিলাম।

ফারহিম ভীনা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের দায়িত্ব পালনের কথা বলা আছে – করোনা আয়নায় দেখি বিদেশ থেকে ফিরে সরকারের সব সতর্কতা, উপদেশ উপেক্ষা করে কক্সবাজার বেড়াতে গেলাম, শপিং করলাম-এমনকি মহা ধুমধামে বিয়ের আয়োজনও করে ফেললাম।

করোনা আয়নায় দেখি আমরা কী নির্লজ্জভাবে শুধু নিজেদের বাঁচার জন্য চেষ্টা করছি। ছয় মাসের খাবার কিনে রীতিমতো গোডাউন বানিয়ে নিশ্চিন্তে সমালোচনা করছি জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বলে। আমরা – হ্যাঁ আমরাই, ক্রেতা এবং বিক্রেতারা, দেখুন করোনার আয়নায়, কীভাবে স্যানিটাইজার, মাস্ক এর কৃত্তিম সংকট তৈরি করেছি। আমরা কি আর মানুষ আছি –চারপাশে ভয়াল থাবা করোনার, অথচ আমরা নিত্যপণ্যের কৃত্তিম সংকট তৈরির অপচেষ্টা করেছি। কোন বাড়িতে কোয়ারাইনটাইনের খবর পেয়ে আমরা নাগরিকরা চিড়িয়াখানা দেখার অবাক আনন্দ নিয়ে ভীড় জমাচ্ছি, কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসার বিষয়ে এই আমরাই অমানবিক আচরণ করছি, অমানবিক আচরণ করছি প্রবাসীদের সাথেও। আয়নায় আমাদের চেহারা দেখা যায় কী সুন্দর!

আইইডিসিআর এর পরিচালক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে আমাদের করোনা পরিস্থিতি অবহিত করছেন। কিন্তু করোনা আয়নায় দেখি উনি কী বলছেন তা নিয়ে নয়, এই কর্মকর্তা কয়টি শাড়ি পরেছেন, কী গয়না পরেছেন তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। বড়ই আজব আমরা। বড়ই রুচিহীন আমরা। এখনও একজন বিশেষজ্ঞকে আমরা শাড়ি আর গয়না দিয়ে দেখি।

করোনার এই আয়নায় কোনো পেশার প্রতি নেতিবাচক মনোভাবও কেমন ফুটে ওঠে। এই বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রথম ও প্রধান যোদ্ধা ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীরা – অবশ্যই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তাদের সুরক্ষা সবার আগে। স্যালুট ও সালাম ডাক্তারদের এই মহত নিবেদনের জন্য। তবে তাদের সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আছে, আছে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরাও।সংকটকালীন দ্রব্যমূল্য মনিটর করা, বিদেশ থেকে আগত নাগরিকদের পরামর্শ প্রদান, কোয়ারাইনটাইন নিশ্চিত করা, জনসাধারণকে জনস্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন করাসহ মাঠ পর্যায়ে সমন্বয় সাধনের কাজ তারা করে চলেছেন। সংকট মোকাবিলা আসলে সমষ্টির দায়িত্ব-আয়নায় দেখি এই মহা বিপর্যয়েও আমরা বিভেদের রেখা টেনে সমষ্টির কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছি।

করোনার আয়নায় আমরা দেখি কীভাবে বারবার মানুষকে বিস্মিত করে হটাৎ আবির্ভাব ঘটে যুদ্ধ আর মহামারীর। ব্ল্যাক ডেথ, প্লেগ, স্পানিশ ফ্লু, কলেরা নিয়ে গেছে কোটি কোটি প্রাণ। করোনা আয়নায় আসুন দেখি প্লেগ নিয়ে কাম্যুর বিখ্যাত আখ্যান-দি প্লেগ। এই কাহিনি শুরু হয় চল্লিশের দশকের শুরুতে আলজেরিয়ার ওরান নামক একটি শহরকে কেন্দ্র করে। এ এক কাল্পনিক নগরীর সন্ত্রস্ত, অসহায় জনপদের সাথে জীবাণুর সংগ্রাম। কাম্যু দেখান প্লেগ গ্রামকে গ্রাম, শহর এর পর শহর উজাড় করে দেয় – একসময় একটি অবরুদ্ধ শহরের দুঃসহ জীবনের শেষ হয়। এই কাহিনিতে আছে নায়ক ডাক্তার রিও, যিনি নিরলস পরিশ্রম করেন রোগীদের বাঁচানোর জন্য। আছে প্রধান গির্জার পুরোহিত ফাথের প্লানারু, যিনি প্রচার করেন এটা ঈশ্বরের অভিশাপ। কাহিনীতে আসে ডাক্তার ও পাদ্রীর দ্বন্দ্ব। কোন মহামারী বেশিদিন স্থায়ী হয় না। একসময় মহাপরাক্রমশালী প্লেগের তীব্রতা কমে আসে, জীবন ফিরে যায় কবিতার ছন্দে। মানুষ ভুলে যায় বেদনার দুর্বহ স্মৃতি, আবারও সাজায় ঘর বাড়ি, হেসে ওঠে তুমুল। অবশেষে কাম্যু তাঁর কলমে দেন অসাধারণ শেষ টান—দূর শহর থেকে ভেসে আসা তুমুল হর্ষধ্বনি শুনতে শুনতে ডাক্তার রিওর মনে হয় মানুষের এই উল্লাস আবার একদিন বিপন্ন হবে, কারণ প্লেগের জীবাণু কখনও ধ্বংস হয় না, হারিয়েও যায় না চিরতরে। বছরের পর বছর এই জীবাণু লুকিয়ে থাকে আসবাবপত্র আর কাপড় চোপড়ের মধ্যে, হয়তো অপেক্ষা করে শোবার ঘরে, ভাঁড়ার ঘরে, বুক শেলফে। তারপর সেই দিনটি আসে যেদিন এই জীবাণু মানুষের সর্বনাশের জন্য, ইঁদুরকে জাগিয়ে তোলে মানুষকে মারার জন্য এবং কোন একদিন সেই জীবাণু ইঁদুরকে পাঠিয়ে দেয় আনন্দমুখর এক শহরে।

করোনা আয়নায় দেখি এই মহা দুর্যোগেও আমরা ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠতে পারি নাই। চীনে করোনার সংক্রমণকে আমরা বলেছি নাস্তিক দেশের ওপর সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ। বলেছি মুসলমানের এ রোগ হবে না –সৌদি আরব আর ইরানের সংক্রমণের পরও দেশে আমরা লাখো মুসুল্লি জমায়েত করে করোনা ঠেকানোর জন্য দোআ করেছি। কিউবা আর রাশিয়ায় এখনো সংক্রমণের খবর আসেনি। অথচ চীনের সাথে রাশিয়ার রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। ওদিকে চীন তাদের দেশের বিপর্যয় মোকাবিলা করে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ইতালির দিকে। সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবার ডাক্তাররাও সাহায্যের জন্য ছুটে গেছে ইতালিতে। আমাদের মেসেঞ্জার ভরে গেছে বিভিন্ন দোআ হাজারবার পড়ার অনুরোধ জানিয়ে।

দোআর নিশ্চয়ই দরকার আছে, কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ আমাদের কই?

মানুষের কবি – সাম্যের কবি কাজী নজরুল সেই সময়েও উচ্চারণ করেছিলেন- আরতির থালা তসবির মালা, আসিবে না কোনো কাজে, মানুষ করিবে মানুষের সেবা, আর সবকিছু বাজে। কী আশ্চর্য করোনার আয়নায় দেখি আমরা হেঁটে যাই পেছনের দিকে।

করোনা আয়নায় আমরা দেখি ধনী দেশগুলো আধুনিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও এ যুদ্ধে কাবু হয়ে পড়ছে। সংক্রমণ রোধে বিমান চলাচল বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরো বিশ্ব কখন যেন এক দেশ হয়ে উঠেছে। মানচিত্র আলাদা হলেও আকাশটা কিন্তু এক।আমরা তাই ইতালির জন্য কাঁদি, স্পেনের জন্য কাঁদি। আয়নায় দেখি পুরো পৃথিবী আজ বড্ড শান্ত-যেন ঘুমিয়ে গেছে প্রাণবান তরুণ, উচ্ছল শিশুরা।

ঘরে থাকা কষ্টকর বটে, আতংক চেপে ধরে| জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচা পড়ুন –এক মহামানব কারাগারে বছরের পর বছর পার করেছেন পরিবার ছাড়া একাকী জীবন। নেলসন ম্যান্ডেলার কারাজীবনও আমাদের এই করোনা জীবনে আলো ফেলতে পারে। তবে এই অন্তরীণ জীবনে গুজব ভয়াবহ বিপদ ডাকতে পারে। করোনা আয়নায় দেখি আমরা নাগরিক দায়িত্ব যথাযথ পালন না করে কেউ কেউ গুজব ছড়াচ্ছি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে করোনা সংক্রমণকে যুদ্ধের সামিল আখ্যা দিয়ে ঘরে অন্তরীণ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছেন| তিনি তাঁর ভাষণে আমাদের সব আতঙ্ককে address করেছেন| জনস্বাস্থ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দিয়েছেন –সরকারের সর্ব প্রকার প্রয়াসের আশ্বাস দিয়েছেন। শিল্পের ক্রান্তিলগ্নে শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধের জন্য অর্থ বরাদ্দসহ সবধরনের নাগরিক সহায়তার কথা বলেছেন| করোনা আয়নায় আমরা তাঁর অসাধারণ বক্তৃতাটা সংরক্ষণ করবো।

আজ মহান স্বাধীনতা দিবস –আসুন করোনার আয়নায় সাম্প্রতিক একটি কবিতার (কবি মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক) চার লাইন যুক্ত করি:

আসুন আবার একাত্তরের মত দাঁড়াই
করোনার কানটা ধরে কালকে তাদের তাড়াই
চার দেয়ালের অন্তরালে থেকেও করি লড়াই
ভালবাসার ভাবনাগুলো ইথার দিয়ে ছড়াই|

করোনা আয়নায় সত্যি আশার আলো আছে। আশার চিত্র এই যে, বাংলাদেশ খুব স্বল্প টাকায় টেস্ট কিট আবিষ্কার করতে শিখেছে। আশার চিত্র এই যে, মাস্ক আর জীবাণু নাশকের সংকট দেখা দিলে বুয়েট আর ঢাকা বিশবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তৈরি করলো তরল জীবাণু নাশক ও মাস্ক। পিপিই ও তৈরি হচ্ছে| ছাত্রদের অমিত সাহস বার বার আমাদের পথ দেখায়। এই আয়নায় দেখা যায় কোন কোন বাক্তি জেগে উঠছেন-ব্যক্তি মালিক স্বল্প আয়ী ভাড়াটেদের ভাড়া মাপ করে দিয়েছেন।

নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিট আশা দিয়েছেন আর সব মহামারীর মতো করোনাও শিগগির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সমস্ত পরিসংখ্যান মিথ্যা করে সকল অমানিশার পর ঠিক সূর্য হেসে উঠবে। আকাশে ফুটবে ঋতুগুচ্ছ মেঘ, উড়ে যাবে রূপকথার পায়রারা। জেগে উঠবে গ্রাম, ব্যস্ত হয়ে উঠবে শহর। শিশুরা ঠিক কল কল করে স্কুল যাবে আর আমরা অফিস যাবার সময় ভাবব অদৃশ্য শক্তিধর শত্রুর বিরুদ্ধে কী লড়াইটাই না আমরা করেছিলাম! আমাদের করোনার আয়নাটা তখন আমরা কী করবো?

শেয়ার করুন: