
সুপ্রীতি ধর: রাজধানীর চামেলীবাগের বাসায় পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমান খুনের ঘটনা মাথা থেকে সরাতে পারছি না কিছুতেই। কাল খবরটি পড়ার পর থেকে স্বাভাবিকই হতে পারছি না। বার বার কেন জানি রুনি-সাগরের কথা মনে পড়ছে। একইভাবে নিজ বাসায় খুন। তবে এক্ষেত্রে সন্দেহের তালিকায় নিহতের ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া মেয়ে। কষ্টটা সেখানেই বাড়ছে।
এ সংক্রান্ত খবরগুলো পড়ে এটা প্রায় নিশ্চিত যে, এই খুনের পিছনে তাদের মেয়েই জড়িত। নিহতের স্বজনেরা এবং পুলিশের সন্দেহের তালিকাতেও ঐশী নামের ওই মেয়েটি। পুলিশ বলছে, ওকে ধরতে পারলেই খুনের রহস্য বের হবে।
আমার এক মন বলছে, বের হোক খুনের রহস্য, আবার অন্য মন বলছে, ঐশীই যদি জড়িত থেকে থাকে, তবে রহস্য কোনদিনই যাতে বের না হয়। ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী মেয়ে তার বাবা-মাকে খুন করে বা করিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, আচরণ করলো সুস্থ-স্বাভাবিকের মতো, এটা তো মানতে পারছি না। নাই বা জানলাম ওর কথা আর! আমাদের সমাজের নৈতিক অধ:পতন কোথায় গিয়ে ঠেকলো তাহলে?
পুলিশের তথ্য এবং স্বজনদের বক্তব্য থেকে পরিস্কার একটা ধারণা মিলছে যে, ঐশী খুবই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, মাদকও নিতো, অনেক রাত করে বাসায় ফিরতো। আমাদের মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি তাল মেলাতে পারার কথা না এ জীবনের সাথে। ওর বাবা-মাও পারেনি। আত্মীয়দের সাথে এ নিয়ে কথা বলেছেন, চেয়েছেন মেয়েকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে, এক পর্যায়ে মেয়ের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। সেটাই হয়েছে কাল।
আমাদের জন্য যা স্বাভাবিক, ওর কাছে তা অস্বাভাবিকই ঠেকেছে। তাই সে নিজের একান্ত পরমপ্রিয় স্বজন, একান্ত আশ্রয়কে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করেনি। শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, খুব শান্তভাবে সে কাপড় গুছিয়ে ছোট ভাই আর গৃহকর্মীকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে, একের পর এক স্বাভাবিক আচরণ করেছে, সবাইকে ফোন করেছে, শান্ত গলায় বলেছে, বাবা-মা রাজশাহী গেছে। এই নির্লিপ্ত গলায় একের পর এক বানানো গল্প সে বলে গেছে, এটাও তো অস্বাভাবিকতা। খুন করিয়েছে, রক্ত দেখেছে প্রিয়জনের, একবারও তার মনটা কেঁপে উঠলো না? এতোটা ভারী মন সে কি একদিনে সঞ্চয় করেছে?
ভাবছি, একটা মানুষ কতটা নৃশংস হলেই এরকম একটা কাজ সম্ভব! ও কিভাবে কাটাবে বাকি জীবন? আজ যখন সব জানাজানি হয়ে গেল, স্বজনদের ভাষ্যমতে, ঐশী যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছে, সেই তৃষারাই বা কিভাবে নেবে বিষয়টা? তাকে কি আর রাখবে তৃষার বাবা-মা? ও এখন কোথায় যাবে? তার উচ্ছৃঙ্খলতার দোসর বন্ধুরা কি তার সহায় হবে আজ? আর ওর ছোট, একমাত্র ভাইটির মনেই বা কি ঘটছে আজ? ও কি কোনদিন পারবে তার বোনকে মেনে নিতে? বাবা-মা-হীন এই পৃথিবী যে তার জন্য একেবারেই অন্ধকার হয়ে গেল আজ?
কিন্তু এমন ঘটনা কেনই বা ঘটলো? যদি বলি, গত কয়েক বছরে এই দেশে যেমন ধর্মীয় অনুশাসনের নামে কিছু মূল্যবোধ চাপানো হয়েছে মানুষের মধ্যে, আর তার ফলশ্রুতিতে দেখছি হিজাব-বোরকার মহামারী, তেমনি পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির অনুকরণেও এখানে চলছে আরেক মহামারী। যেমন পোশাক-আশাকে, তেমনি জীবনাচরণেও। আর এরই ফাঁক দিয়ে হুড় হুড় করে ঢুকছে মাদক। হাতের নাগালে এখন মাদক। তারই করালগ্রাসে পড়ে যাচ্ছে আমাদের একটি প্রজন্ম। লোপ পাচ্ছে বোধবুদ্ধি, মূল্যবোধ বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো এক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখছে। এই মাধ্যমের পাঠ্যপুস্তক আসে বাইরে থেকে। আর এখানকার শিক্ষকরাও উৎসাহী হন না বাংলা ও বাঙালী এবং বাঙালী সংস্কৃতি সম্পর্কে ন্যুনতম জ্ঞানটুকু দিতে। তাই যা হওয়ার, তাই হচ্ছে।
চামেলীবাগের এই খুনের কথায় আমার চিত্তচাঞ্চল্যের আরও একটি কারণ, ঐশীর বয়সী একটি ছেলে আমার ঘরে। আমার মেয়েটি সেই বয়স পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। ওকে নিয়ে আমার কোনদিন কোন বিড়ম্বনা হয়নি, অন্তত উচ্ছৃঙ্খলতার বিড়ম্বনা আমার মেয়ে আমাকে দেয়নি। বলবো না যে, ছেলে আমার উচ্ছৃঙ্খল, কিন্তু তারপরও প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মধ্যে সে রাখে। নানা ঘটনা-অঘটনের মধ্য দিয়ে পার করি একেকটা দিন। ওদের বন্ধুদের যে গ্রুপ, তাকে পছন্দ না করে এবং ছেলেকে এখান থেকে বাঁচাতে আমার ছেলের এক বন্ধুর মা পাড়ি জমিয়েছেন কানাডায়। কিন্তু আমরা যারা সেই সুযোগ বা সামর্থ্য রাখি না, তারা কি করবো? কোথায় যাবো ছেলেকে নিয়ে? নাকি কোন একদিন আমিও এভাবে শিরোনাম হবো পত্রিকার পাতায়? কে জানে!