স্যালুট, আমার বাংলার নারী ক্রীড়াবিদদের

মনিজা রহমান:

কেউ কেউ আছেন যারা সাধারণভাবে কথা বললেও মজা লাগে। দৈনিক জনকণ্ঠে আমার এক সহকর্মী ছিলেন- হাজি জহির ভাই। এক সময়ের নামকরা আলোকচিত্রশিল্পী। ঘটনাটা ২০০৪ সালের অক্টোবরের দিকে হবে। হঠাৎ একদিন বিকেলে আমার মোবাইলে ফোন করে বললেন, ‘মানিজা (উনি আমাকে এভাবে ডাকতেন), তুমি কিন্তু আইজকা স্টেডিয়ামে দিকে আইসো না। ভয়াবহ অবস্থা!’

আমি সেদিন বিকেলে স্টেডিয়ামে গিয়েছিলাম। তবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে নয়। কমলাপুরে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে। কারণ সেখানে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল। বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলবে? হাফপ্যান্ট পরে মাঠে দৌড়াবে? গ্যালারি ভর্তি পুরুষ দর্শকদের সামনে বল নিয়ে ছোটাছুটি করবে? ধর্মান্ধ-মৌলবাদীরা সেটা মানবে কেন?

সেদিন শুক্রবার ছিল। জুমার নামাজ শেষে কাঠমোল্লাদের সেকী মাতম! তাদের জঙ্গী মিছিল ছিল স্টেডিয়াম চত্বরে। ভাঙ্গচুর, বোমাবাজি, অগ্নিপ্রজ্জ্বলন কিছু বাদ রাখেনি সেদিন তারা। পুরো গুলিস্তান এলাকা হয়ে যায় রণক্ষেত্র।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা কিন্তু এখন নিয়মিত খেলে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ থাকলে স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। সাবিনা কিংবা সুইনু প্রু গোল করলে স্টেডিয়ামের গ্যালারি সমুদ্রের গর্জনের মতো আনন্দে ফেটে পড়ে। গত বছর বঙ্গমাতা অনুর্ধব-১৯ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে আরব আমিরাত ও কিরঘিজস্তানকে পরাস্ত করে সেমিফাইনালের টিকেট পায় স্বপ্না-কৃষ্ণারা। সেমিতে তারা মঙ্গোলিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়ে পুরো বাংলাদেশে ফুটবলের মাতম তোলে। তবে ঘুর্ণিঝড় ফণী এসে ভণ্ডুল করার কারণে লাওসের সঙ্গে বাংলাদেশকে যৌথ চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার এক অজপাড়াগাঁ কলসিন্দুর গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। কিন্তু ওই গ্রামের ক্ষুদে ফুটবলার মেয়েরা, জাতীয় পর্যায়ের স্কুল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গ্রামে বিদ্যুৎ লাইন এনে দেয়।

সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের নারী ফুটবল ও ক্রিকেটের সূচনাকালের সাক্ষী আমি। পাক্ষিক ক্রীড়ালোকের হয়ে জীবনে প্রথম রিপোর্টিং করতে গিয়েছিলাম ১৯৯৭ সালে, ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। প্রবীণ কোচ আলতাফ হোসেনের অধীনে নারী ক্রিকেটারদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতির অনুশীলন ছিল সেদিন। বলাবাহুল্য সেবার বিশ্বকাপে মেয়েদের পাঠানো হয়নি। মেয়েরা গিয়ে লেজে গোবরে করে দেশ জাতির মুখে কালি ছিটাবে এই ছিল ক্রিকেট বোর্ডের শংকা। কোনো লক্ষ্য নেই, টুর্নামেন্ট নেই… তবু দিনের পর দিন নারী ক্রিকেটাররা তাদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছে। অবশেষে ২০০৮ সালে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে প্রথম ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বিসিবি। সেবার বোর্ডের নারী ক্রিকেট উইংয়ে এক সদস্য ছিলাম আমি। আর এভাবেই আরম্ভ।

মজুরি বৈষম্য, বেতন কাঠামো কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা যাই বলুন, ফুটবল-ক্রিকেটে পুরুষদের তুলনায় বাংলাদেশের নারীদের পার্থক্য এখনও দিনরাতের। অথচ পুরুষরা যেটা আজো পারেনি, ভারত-পাকিস্তানকে হারিয়ে এশিয়া কাপ ক্রিকেটের শিরোপা জিতে মেয়েরা সেটা করে দেখিয়েছে। খেলাধুলা করে নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক যখন খুলনায় তার গ্রামের টিনের বাড়ি পাকা করে, তখন পুরুষ দলের অধিনায়ক ঢাকায় দামী ফ্ল্যাট কেনে, মফস্বলে রাজকীয় প্রাসাদ বানায়। তবু মেয়েরা মুখ বুঁজে, বিনা প্রতিবাদে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে অনুশীলনে; নিজেকে উজাড় করে দেয় ম্যাচে, সমাজের সমস্ত বাধা ডিঙ্গিয়ে-রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পা রাখে ক্রীড়াঙ্গনে। বহু কষ্টে পাওয়া সুযোগটুকু তারা শতভাগ কাজে লাগায়। যে কারণে কোনো পুরুষ ক্রীড়াবিদ নয়, ১২তম সাউথ এশিয়ান গেমসে ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত ও সাঁতারু মাহফুজা শিলার কারণে বিদেশের মাটিতে বাজে –‘আমার সোনার বাংলা’।

এই বিজয়ী মেয়েদের মধ্যে একটা আগুন কাজ করে। সেই আগুন আজন্ম দারিদ্র্যতা, অভাব-অনাহার, একটা ভালো পোষাক পরতে পারার না বেদনার ক্ষোভ থেকে উৎসারিত। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত ঢাকায় একটি আধুনিক-শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষার স্মারক ছিল- পরিবারের মেয়েটিকে খেলাধুলায় পাঠানো। আমার জন্ম যে এলাকায়, সেই পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে উঠে এসেছেন- পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে প্রথম স্বর্ণপদক প্রাপ্ত বাঙালি খেলোয়াড় জিনাত আহমেদ। জিনাত, লুৎফুন্নেসা বকুল, কাজী জাহেদা, ডলি ক্যাথরিন ক্রুজ, রওশন আক্তার ছবি, সুলতানা কামালরা পাকিস্তানের মেয়েদের পরাস্ত করে স্বর্ণপদক তুলতেন গলায়। দেশ স্বাধীন হবার আশির দশক পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। এই ধারায় জোবেরা রহমান লিনু বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়াবিদ, যিনি গিনেজ বুক অব রেকর্ডসে নিজের নাম তুলেছেন। দাবাড়ু রানী হামিদ কিংবা শুটার কাজী শাহানা হয়েছেন কিংবদন্তিতূল্য নাম।

মনিজা রহমান

তারপর? তারপর স্বৈরাচারী সরকার নব্বই দশকে ক্ষমতায় আসার পরে ধস নামতে থাকে নারীদের খেলাধুলায়। সাঁতারের মতো অলিম্পিক গেমসের একটি জনপ্রিয় খেলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। তখন বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা পুরুষ বর্জিত সুইমিং পুলে মিডিয়ার অগোচরে কালেভদ্রে সাঁতার টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে পারতো।

শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা মুখ ঘুরিয়ে নেয় ক্রীড়াঙ্গন থেকে। গ্রামীন জনপদ থেকে উঠে আসা প্রান্তিক জনগোষ্ঠি সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে। ঘোর অমানিশা কাটিয়ে ২০০৮-০৯ সাল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলা। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি মেয়েরা এই বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। খুলনা-ফরিদপুর-কুষ্টিয়া-ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা যোগ দেয় তাদের সঙ্গে।

বিশ্বে নানা সূচকে বাংলাদেশের নারীদের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গর্ব করার মতো। কিন্তু গ্রামীণ সমাজ মেয়েদের বাল্যবিবাহের ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। এটা এখনও বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে একটি বিরাট সমস্যা। সামাজিক অস্থিরতা, মুল্যবোধের অবক্ষয়, অর্থনৈতিক সংকট সব মিলিয়ে গ্রামের দরিদ্র পিতামাতাকে বাধ্য করছে তার কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেবার জন্য। তারপর সেই মেয়ে যখন নিজেই একজন শিশু, তখন সে একজন শিশুর মা হয়ে যায়। যে মেয়েটি সাঁতার টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বিকিনি বা সুইমিং কস্টিউম পরে, গ্রামে গিয়ে সেই মেয়েটি আবার বোরকা পরে মাদ্রাসায় পড়তে যায়।

ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের সাফল্য বাল্যবিয়ে বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে ও আগামীতে আরো করতে পারবে। মেয়েরা যখন সেনাবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিজিএমসি’র হয়ে খেলবে, খেলবে আবাহনী-মোহামেডানের মতো নামকরা ক্লাবের হয়ে, করপোরেট লীগে অংশ নেবে, তখন তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। এমনকি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রিকেটার জাহানারা আলম বিদেশী কোটায় ভারতের আইপিএলে খেলে, স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন অংশ নেয় ভারত ও মালদ্বীপের শিরোপার রেসে থাকা ফুটবল ক্লাবে।

একদিন এই মেয়েদের ছনের ঘর ভেঙ্গে পাকা বাড়ি হয়। পাশের বাড়ির মেয়েটিকে ভালো পোষাক, ঢাকায় গিয়ে ক্যাম্প অনুশীলন করতে দেখে অন্য বাড়ির মেয়েটিরও নিজেকে উত্তরণের ইচ্ছে জাগে। খেলাধুলা নারীর ব্যাক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। আত্নবিশ্বাসী করে তোলে শারীরিক ও মানসিকভাবে।

সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের কাছে হয়তো ‘বিশ্ব নারী দিবস’ এর গুরুত্ব না থাকতে পারে। কিন্তু এই সংগ্রামী মেয়েদের কাছে আছে। তারা রঙ মেখে সঙ সাজে না। কোন সভা-সমিতিতে গিয়ে ‘নারী দিবস’ নিয়ে বক্তৃতা দেয় না। দেয়ার প্রয়োজনও পড়ে না। শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জন্মভূমির পতাকাকে তুলে ধরে বিশ্বের সামনে। বিশ্ব নারী দিবসে আমার স্যালুট এই বিজয়ী মেয়েদের জন্য। তারাই ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে দিন বদলের গান।

শেয়ার করুন: