যে ধর্মে ভাতের গন্ধ নাকে আসে, সেটাই আমার ধর্ম

শবনম সুরিতা:

নতুন পাড়ায় থাকতে শুরু করেছি কয়েক সপ্তাহ হলো। প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার পথে একটা কফির দোকান থেকে কফি কিনি। আজও ঢুকলাম। দোকানের এক কর্মচারী পাঞ্জাবীভাষী ভারতীয়। জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। বললাম, কলকাতা। দ্বিতীয় প্রশ্ন, “আপনি কি হিন্দু?”

উত্তর না দিয়ে কথা এড়িয়ে কফি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। ২০ মিনিটের রাস্তা। যেতে যেতে ভেবে দেখলাম, এই প্রথম কারো সাথে পরিচয় হবার এত তাড়াতাড়ি কেউ আমায় আমার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করলো। বেশ অবাকই লাগল। আমার কি ওর সাথের ওইটুকু সম্পর্কের কোথাও ধর্ম পরিচয়ের আবশ্যিকতা ছিল? না মনে হয়। গত কয়েক বছর ধরে দেশে যে ধরনের ধর্মচর্চা প্রাধান্য পাচ্ছে, আজকের ঘটনাকে সেই মাপকাঠিতে ফেলে ভাবলাম। উত্তর পালটে গেল মাথার মধ্যে।

আমি উচ্চ-মধ্য বর্ণ হিন্দু পরিবারে ঘটনাচক্রে জন্মানো মেয়ে। নিয়ম মতে তো আমার সত্যিই রোজ ভাবার কথা যে আমার শরীরে প্রবেশ করা প্রতিটা খাদ্যদানার গায়ে কোনো ম্লেচ্ছ-বেজাত-কুজাতের ছোঁয়া লেগেছে কি না। দোকানের সেই কর্মীটিরও হয়তো তেমনই কোনো আশঙ্কা ছিল। কে জানে!

এতদূর ভাবতেই প্রচণ্ড হাসি পেলো। এই যে আমি জার্মানিতে থাকি, এখানে রোজ যা খেয়ে বাঁচি, তাঁর প্রতিটি গ্রাসে এখন জাতের অঙ্ক মেলাতে বসলে তো আমার অভুক্ত হয়ে মরার কথা।

আমার ইচ্ছে মতো একদম কলকাতার রোববারের বাজারের মাংসওয়ালার মতো পরিচিত তুর্কিশ দোকানে গোটা মুরগি ‘কারি’ কাটের আদলে কেটে দেয়। পছন্দমতো হাড়-মাংসের টুকরো মিশিয়ে হাতে তুলে দেয় ভেড়া বা গরু, যেদিন যেমন মুড। সাথে ২০০ গ্রাম কচকচি বা কলিজা ফাউ, মেলা দিনের ক্রেতা বলে। যে দোকান থেকে গোবিন্দভোগ চাল, মাছ, মসলা ইত্যাদি কিনি তার মালিক এক বাংলাদেশি ভাই, ঘটনাচক্রে যিনি মুসলমান। যে দোকান থেকে মেথিশাক, এঁচোড়ের মতো “ভারতীয়” উপকরণ কিনি, তার মালিক আফগানিস্তানের নাগরিক। তিনিও মুসলমান। কারিপাতা, দক্ষিণ ভারতীয় মশলার জন্য নতুন বাড়ির ঢিল ছোঁড়া দূরত্বের শ্রীলঙ্কা থেকে আসা এক তামিলভাষী হিন্দু জুটির দোকানই ভরসা। আর রোজকার আনাজ, রুটি, ডিম ইত্যাদির জন্য জার্মান সুপারমার্কেট তো আছেই। এরাই আমার খাবারের জোগান দেন। যত দোকানের নাম করলাম, কেউ আজ পর্যন্ত আমার ধর্ম জানতে চায়নি। অথচ প্রতি দোকানেই সেখানের মানুষজনের সাথে কমবেশি গল্প করি আমি। বাচাল স্বভাব এমনিতেই। কী আর করা।

অথচ মজার বিষয়, আফগান দোকানেরই একটা বিরাট কোণ জুড়ে থরে থরে সাজানো আছে পুজোর সামগ্রী। অগুরু, ধূপকাঠি, ধূপদানি, ঘন্টা, কৌটোবন্দী গঙ্গা জল, সিঁদুর, কুমকুম- সব! শুধু একবার এই দোকানের দোকানি জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার মাতৃভাষা কী। বললাম বাংলা। সাথে সাথে আমায় উর্দু-হিন্দি মিশিয়ে বললেন, “ফ্রেশ পোই-সাগ (বাঙালির পুঁইশাক আর কি) আয়া হ্যায়। চাহিয়ে তো থোড়া দে দু আপকো?”

হায় রে বাজার!
এই যত্তসব গণ্ডগোল। সবার ওপরে বাজার সত্য, তাহার ওপরে নাই। তা না হলে বৃত্তি আর উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার লোভে কস্মিনকালেও দেশ ছেড়ে বিদেশে আসতাম না। বাজারের তুলনায় ধর্ম বড় প্রমাণিত হলে কোনো পুজো-আচ্চার জিনিস ওই দোকানে বিক্রি হতো না। বাজারে চাহিদা নিজের খাদ্যাভাস অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছাকে ছাপিয়ে না গেলে কোনো আফগান বাঙালি = পুঁইশাক, এই সমীকরণ শিখতো না। মূর্তিপূজা হারাম, এই বিশ্বাসে আটকে থেকে দোকানে মূর্তিপূজার সামগ্রী নাও রাখতে পারতেন তিনি। কিন্তু না। প্রমাণ হয়েই গেল দিনশেষে বাজারই শেষ কথা বলে।

হায় রে পেটের টান!
পেটের টান, বা বলা ভালো নোলার টান, না থাকলে আমারও বরফজমা ঠাণ্ডার দেশে মাঝরাতে ছোট ট্যাংরার ঝোলের জন্য মন আনচান করতো না। করলো, আর আমিও অমনি মাসকাবার হতে না হতেই, ব্যাংকে টাকা আসতে না আসতেই একছুট্টে পাঁঠার মাংস, লটে শুঁটকি, পুঁইশাক দিয়ে ফ্রিজ ঠেসে রাখতাম না।

হায় রে নস্টালজিয়া!
দেশে থাকতে কস্মিনকালেও বড়ি জিনিসটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। শুক্তোয় মিশে থাকে। মাছের ঝোলে পড়ে থাকে। ব্যস ওইটুকুই। এখানের দোকানে বড়ি না পেয়ে অথচ ইউটিউবে বারবার তার বদনখানি দেখে জীবনের যত বড়ি-গল্প সব একে একে স্বপ্নে আসতে লাগলো। ওই যে সেবার বাবা-পিসিদের কোন শিক্ষিকার মাথার খোঁপা বড়ির সাইজের ছিল! সেই গল্পের গরু চুলের খোঁপা বেয়ে মাছের ঝোলের টলটলে রসে পরিণত হলে তবে গিয়ে ঠেলার নাম বাবাজী হয়। আর আমি ৩৫ ডিগ্রির গরম আর দিনের ১৪ ঘণ্টার ক্লান্তিবিহীন সূর্যের সুযোগ নিয়ে বারান্দায় বড়ি দিই।

এতকিছু লিখলাম কারণ যা বুঝলাম, শেষে গিয়ে ওই পেট আর মন, ওই দুইয়েই আটকে আমার গোটা পৃথিবী। শুধু আমার কেন, সব প্রবাসীরই বোধহয় একই গল্প। যে প্রবাসীদের এই দুইয়ের কোনো টান নেই, তাদের সহজে ভরসা করবেন না। যারা নিজের মন-পেটকে একসাথে ঠকাতে পারে, তাদের দ্বারা এক-দুটো দাঙ্গা বাধানো, দু-তিনটে দেশ ভাঙানো, চার-পাঁচটা লোক ক্ষেপানো কোনো ব্যাপারই না। ডেঞ্জারাস!

তারা আমাদের মতো আপোষের জীবনে প্রতিনিয়ত প্রাণের খোরাক খোঁজে না।
তারা পরিচয়ের দ্বিতীয় প্রশ্নে এসে ব্রেক কষে, আর বাকি সময়টা গোঁজামিল দিয়ে বেড়ায়। আমার ওদের জন্য খুব কষ্ট হয়। আহা রে! তাদের রাতের পর রাত সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংসের চিন্তায় কাটে না। প্লেটে ধরা রুটি, অথচ ফ্ল্যাশব্যাকে রাধাবল্লভী-আলুর দম তাদের চোখের সামনে ভাসে না আমি নিশ্চিত।

আচ্ছা, ওদের নিশ্চয়ই অনেক মেধা। অঙ্কেও নিশ্চয়ই খুব প্রখর।
ওদের সমীকরণের দুদিক সমান হয়? লেফট হ্যান্ড সাইড = রাইট হ্যান্ড সাইড হয় কি? আমি জানিনা। আমি অঙ্কে একশোয় ছয় পেয়েছিলাম একবার। আমি অঙ্কে কাঁচা হলেও ইতিহাসে পাক্কা।
তবুও কেন জানিনা আমার অঙ্কে দুদিক মিলে যায় ঠিক। স্পষ্ট দেখতে পাই কী সুন্দর মিলে যাচ্ছে সমীকরণের দুদিক। ঠিক যেন কাঁটাতারের এপার আর ওপার। “=” চিহ্নের বাঁদিক আর ডানদিকের মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই। দুদিকের সংখ্যার মধ্যে যা তফাত তা কেবল ওই দৃষ্টিভঙ্গীর আর কি।

আমার সমীকরণে যাহা শুক্তো, তাহাই সাতকড়া। যাহা চিনিগুঁড়া, তাহাই গোবিন্দভোগ। যাহা মেথি, তাহাই পুঁই।

কাল সেই দোকানিকে পেলে কী উত্তর দেবো ভেবে রেখেছি। বলবো, খিদে পেলে যে ধর্মে ভাতের গন্ধ নাকে আসে, সেটাই আমার ধর্ম। আমি ভরপেটে বিশ্বাসী।

শেয়ার করুন: