ফারজানা নীলা:
নারী পুরুষ উভয়ই তেড়ে আসবে শুনে যে মেয়েদের উপর দায়িত্ব দিন মানে কী? মেয়েদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় না নাকি? তারাই তো সংসার সামলায়, ঘরের দায়িত্ব, সন্তানের দায়িত্ব সব তো তারাই সামলায়। মেয়েরা কি দায়িত্ব ছাড়া থাকে?
উপরোক্ত সকল দায়িত্ব মেয়েরাই পালন করে, তাদের উপরই বর্তায়। দায়িত্ব ঘরের, দায়িত্ব সন্তানের দেখভালের, দায়িত্ব স্বামী আত্মীয় স্বজনদের ভালোমন্দ দেখার। এই দায়িত্ব ছাড়া আর কী দায়িত্ব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সবাই? আর কোনো দায়িত্বের কথা কি মাথায় আসছে? সম্ভবত না। মেয়েদের এইসব করাই একমাত্র বা অন্যতম বা প্রধান দায়িত্ব। চোখবন্ধ করে কখনও সংসারের খরচ চালানোর দায়িত্ব দিয়েছেন? নিশ্চিন্তে সন্তানের লেখাপড়ার খরচের দায়িত্ব দিয়েছেন? বাবা মায়ের ওষুধের খরচ? বাড়ি ভাড়ার খরচ? গরীব আত্মীয় স্বজনদের দান-খয়রাতের দায়িত্ব?
স্বেচ্ছায় অন্তত দেয়নি কেউ। কারণ আমরা দায়িত্ব ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছি। ছেলেদের দায়িত্ব মানে সংসার চালানোর জন্য যে আর্থিক সহায়তা লাগবে, সেটা দেখবে ছেলে। আর সেই আর্থিক সহায়তা দিয়ে সংসার চালাবে মেয়ে। দায়িত্বের অদলবদল হতে দিতে চাই না।

কারণ আছে তিনটি:
প্রথমত: মেয়েরা পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারবে না। তারা হয়তো চাকরি ব্যবসা কিছু করতে পারে, কিন্তু একটা পরিবার সম্পূর্ণভাবে মেয়ের অর্থের উপর নির্ভর করবে কেন? তারা চাইলে খরচের অংশীদার হতে পারে, কিন্তু পুরোটা অবশ্যই নয়। মেয়েদের আগে ঘর সংসার সন্তান সামলাতে হবে, এরপর অন্যকিছু, যদি পারে। আর পুরো সংসারের দায়িত্ব নেওয়া অনেক কঠিন। এসব কঠিন ব্যাপারে মেয়েরা জড়াতে পারে না।
দ্বিতীয়ত: মেয়েরা অর্থ উপার্জনে বেশি মনোযোগ দিলে পরিবার, সন্তানের প্রতি মনোযোগ কমে যাবে।
তৃতীয়ত: সম্পূর্ণভাবে মেয়েদের উপার্জনের উপর নির্ভর করলে পুরুষদের আত্মসম্মানে লাগে।
এছাড়াও হয়তো আরও কারণ থাকতে পারে আমার কাছে এগুলোই মুখ্য মনে হয়েছে।
এই কারণগুলোর জন্য মেয়েদের কখন শেখানো হয় না, তুমি বড় হয়ে পরিবারের হাল ধরবে। তোমার বাবা রিটায়ার করলে তুমি হবে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। শেখানো হয় না তোমার ভাই যেমন এই পরিবারের জন্য অর্থ সহায়তা দিবে, তুমিও সমান সমান দিবে। শেখানো হয় না, তুমি মেয়ে বলে ভেবো না তোমার উপার্জন না করলেও চলবে! বা উপার্জন করলেও সেটা শুধু ব্যাংকে জমা করার জন্য! প্রতিমাসে তোমাকে সংসারের খরচের জন্য আর্থিক সহায়তা করতে হবে, যেমন তোমার ভাইও করবে। শেখানো হয় না যে স্বামী সন্তান ঘরদোর সামলানোই শুধু তোমার কাজ না। তোমার নিজের একটি আলাদা নাম হবে আগে বাদবাকি সব পরে। তোমার সার্টিফিকেটগুলো শুধু আলমারিতে রাখার জন্য না, বা এগুলো দেখিয়ে ভালো বর পাওয়ার জন্য না। এগুলো খাটিয়ে নিজের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে হবে। ভেবো না যে ভাই আছে, আমাকে কিছু দিতে হবে না। ভাই যেমন সদস্য, তুমিও সদস্য। তারও হাত পা আছে, তোমারও আছে। তার যোগ্যতা আছে তোমারও আছে।
এতো গেলো মেয়েদের কী কী শেখানো হয় না।
ছেলেদেরও সমানভাবেই অনেক কিছু ভুল শেখানো হয়। শেখানো হয়, সেই বংশের বাতি। তাকেই হাল ধরতে হবে। বোনদের বিয়ে দিতে হবে, ঘরের চালচুলো ঠিক করতে হবে। শেখানো হয় না, তুমি এবং তোমার বোন দুজনে মিলে সংসারের চালচুলো ঠিক করবে। তুমি ছেলে হয়েছো বলে অফিস থেকে এসে সোজা টিভির রুমে বসে থাকতে পারবে না, আর তোমার বোন অফিস শেষে ঘরের কাজ করবে। আয় এবং ঘর দুজনের সমান হলে দায়িত্বও সমানভাবে বণ্টন হওয়া উচিত।
ধরেই নিয়েছি আমরা, মেয়েরা পুরো পরিবারের দায়িত্ব নিতে জানে না বা পারে না। অথচ যারা নেয় তাদের সফলতার হারই বেশি। যদিও পরিবারের সবচেয়ে আপনজনদের মুখ থেকে অনেক হায় হতাশার কথা শোনা যায়। “ইশ আজ যদি আমার ছেলে থাকতো, মেয়েকে এত কষ্ট করতে হতো না”।
কেন, ছেলে থাকলে মেয়ে কষ্ট করবে না কেন? উত্তর দিবেন, মেয়েদের বিয়ে করে চলে যেতে হয়, স্বামী সংসার সন্তান সামলাতে হয়। এরপর আবার বাড়তি আয়ের দায়িত্ব দিলে তো ওরা হিমশিম খাবে!
সেখানেও যদি কেন তুলি? কেন সংসার সন্তান শুধু মেয়েরাই সামলাবে? সংসার দুজনের যদি হয় তবে সেখানে দায় দায়িত্ব দুজনের সমান হওয়ায় কথা। একজন সন্ধ্যায় এসে বাতাস খেতে বসে যাবে, আরেকজন সারাদিনই খেটে যাবে, তা কেন হবে? একজনের বাবা মা অসুস্থ অসহায়। তারপরও কেন মেয়েকে বাবা মা ছেড়ে চলে আসতে হবে?
মোটকথা দায়িত্ব দুজনের সমান হতে হবে। দুজনই আয় করবে, দুজনই পরিবারের দায়িত্ব নিবে। আবার কিছু ক্ষেত্রে মেয়েরা আয় করলেও সেটা শুধু জমানোতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণ তারাও চায় যে সংসারের জন্য উপার্জন শুধু পুরুষরাই করবে। সে মেয়ে হয়ে যদি আয় করেও বা সেটি তার খরচ না করলেও চলবে, কারণ খরচ করার দায়িত্ব শুধু পুরুষের। এই মানসিকতার জন্য মেয়েদের আপনারা দোষী ভাবতে পারেন। বলতে পারেন যে এই কারণেই মেয়েদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় না।
দোষী তো অবশ্যই। কিন্তু এই দোষ তারা জন্ম থেকে পায়নি। আশেপাশে দেখতে শুনতে হয়েছে। সে তো দেখে আসছে, শিখে আসছে পরিবার কীভাবে চলে, কারা কী কাজ করে। তার মাথায় এই চিন্তা ঢুকিয়েছে স্বয়ং পুরুষতন্ত্র।
হ্যাঁ তাকে দোষ দিতে পারেন এইজন্য সে কেন তার বোধবুদ্ধি খাটিয়ে বিবেচনা করলো না কেন এমন নিয়ম, কেন এমন দায়িত্বের ভাগবাটোয়ারা? তাকে দমিয়ে রাখার জন্য? তার মধ্যে যে দক্ষতা, যোগ্যতার অভাব আছে, যার কারণে সে নিতে পারবে না এই গুরুদায়িত্ব, এই বোধ জন্মানোর জন্য? তাকে ভাত কাপড়ের জন্য পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে আজীবন এই চিন্তায় অভ্যস্ত করার জন্য?
বোধের অভাবে মেয়েদের শুনতে হয়ে “সারাদিন তো ঘরে থাকো, রান্না করতে এত কষ্ট লাগে? বাইরে গিয়ে দেখো না টাকা কামাতে কত কষ্ট”!
এই যে খোটাগুলো মারে আমাদের পুরুষরা, এই খোটাগুলো শুনতে কেন হবে? পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের যোগ্যতা কি কোনও অংশে কম? হাত পা কি একটা দুইটা কম?
স্কুল কলেজে দেখা যায় মেয়েদের উপচে পড়া ভিড়। তাহলে দায়িত্ব নেওয়ার বেলায় কয়েকজনই কেন দেখা যায়? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা যায় না? সমান সমান সংখ্যা হতে আর কত দেরি! যতদিন মেয়েকে এবং ছেলেকে একই শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন না, একইভাবে বুঝাবেন না যে দুজনকেই সমান দায়িত্ব নিতে হবে, ততদিন সমান সমান দায়িত্ব নেওয়ার রীতি চালু হবে না।
মেয়েদের দায়িত্ব নিতে দিন তাতে আপনাদের পুরুষদের উপরই একটু কম চাপ পড়বে।