তানবীরা তালুকদার:
আর দশটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের মেয়ের মতো আমিও নসিহত শুনে শুনেই বড় হয়েছি। এটা করলে মানুষ কী বলবে, ঐটা করা ধর্মে নিষেধ, আমাদের বংশের মেয়েরা এগুলো করে না। আর তার মধ্যে সবচেয়ে নসিহত দ্যা গ্রেট ছিলো, এসব করলে তোর বিয়ে হবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই পাকনা কাল থেকেই নসিহত ব্যাপারটার প্রতি চরম একটা বিতৃষ্ণা আরও অনেক ফাজিল মেয়ের মতো আমারও ছিলো, এখনও আছে।
লাইভ ওয়াজ শুনতে যাওয়ার ভাগ্য হয় নাই। হুজুররা শুনলে অবশ্য বলবে, বাম্ববার লাইভ কনসার্টে যেয়ে তো নাচতে পারছো টি-এস-সির মাঠে, পারো নাই শুধু আমাদের ভালো ভালো কথা শুনতে আসতে। তবে, নেভার দ্যা লেস, প্রতি শুক্রবার লাইভ খুতবা শুনেছি, মসজিদের মাইক দিয়ে দিকে দিকে খুতবা ছড়িয়ে দেয়া হতো। আর কোথাও মিলাদে গেলে আসল মিলাদের আগে হুজুদের বয়ান কিংবা নসিহত।
তখনকার বিষয় ছিলো, না খেতে পাওয়া মা ফাতেমা, মা আমেনা, বুররাকে চড়ে সাত আসমানে যাওয়া আর অবধারিত ভাবে জাহান্নামী নারীদের হাই হিল, ভ্যানিটি ব্যাগ আর নাভির নিচে শাড়ি। এই বিষয়ের মধ্যেই ঘুরপাক খেতো।
মা ফাতেমা’র না খেতে পাওয়ার কাহিনী বর্ণনার সময় হুজুররা কীরকম আহাজারি করে কাঁদতো, শ্রোতামণ্ডলীর অনেকেও শুনতে শুনতে জোরে জোরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়তো, আমি আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকতাম, অজানা অচেনাদের জন্যে কান্নাকাটি করার মতো মন কিছুতেই নরম হতো না, সামনেই কত অনাহারী দেখেছি এবং জেনে গেছি সেসব আমার ব্যাপার না। র্যাদার মন উচাটান থাকতো সদ্য গরু কেটে রান্না করা সুগন্ধি ছড়ানো তেহারি কখন খেতে পাবো সেই আশায়।
আমি অত্যন্ত মুগ্ধ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি, বিশ্বায়নের যুগে ওয়াজ শিল্পও পিছিয়ে নেই। হুজুররা বুঝে গেছে পাঁচশো সত্তর খ্রিস্টাব্দ নিয়ে এখন আর মানবজাতি বদার্ড না। মা ফাতেমা, মা আমেনা আর বুররাক দিয়ে বাণিজ্য হবে না। বাংলাদেশের বাংলা সিনেমার গল্প আর প্রযুক্তি থেকে হুজুরদের চিন্তাধারা আধুনিক ও উন্নত। তারা তাদের শিল্পকে নবায়ন করেছেন আজকের প্রেক্ষাপটে। আজকের ওয়াজের বিষয়, মেয়েদের জিন্স, ডোনাল্ড ট্রাম্প, ফেসবুক, ভাইরাল, ইউটিউব, বেলগ্রেড এমনকি করোনা ভাইরাস।
মানুষের ঈমান দুর্বল বলে তারা কোরান থেকে রেফারেন্স দেয়া বন্ধ করেছেন, তারা প্রতি কথায় রেফারেন্স টানেন নাসা’র বিজ্ঞানীদের! কোন রেফারেন্সে মানুষ আস্থা রাখে সেই বাজার তাদের যাচাই করা হয়ে গেছে।
বাণিজ্যে যারা মাত দিতে চান, ওয়াজের সালমান এফ রহমান কিংবা আব্দুস সোবাহান আবার আধুনিক হিন্দী সিনেমার চটুল গানের সুর নকল করে গানে গানে বয়ান দেন। কেউ কেউ আবার স্টেজে নেচেও দেখান। হুরপরীদের আশা ভরসা তারা করেন না। ঠিক যেমন হিরো হিরোইনরা আজকাল স্টান্ট ব্যবহার না করে নিজেরাই শট দেন, অনেকটা সেইরকম না?
তারা জেনে গেছেন, আজকের এই মুহূর্তটাই সত্য। দিনের শেষে সবই টাকা, সবই বিনোদন। কোটি কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট এই শিল্পে, অতঃপর আমরা তার কোন অবদান অস্বীকার করবো!
নসিহতে বিতৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও শিল্পের আধুনিকায়ন ও বাস্তবমুখিতায় আমি বিমোহিত ও মুগ্ধ।