কেন পড়বেন বীথি সপ্তর্ষির ‘নারীবাদী প্রস্তাবনা’ বইটি!

শামীম আরা নীপা:

অনুবাদগুলো পড়ার আগে আমি ভয় পাই কারণ সবার অনুবাদ পড়া সহজ না। যেকোনো বই এর অনুবাদ বিশাল এক দায়িত্ব মনে করি আমি। দায়িত্বটা পাঠকের প্রতি উপস্থাপনের এবং পাঠকের বোধকে স্পর্শ করতে পারার।

বীথি সপ্তর্ষি দুর্দান্ত অনুবাদ করেছে আমি বলবো। কারণ আমি তার কথাগুলো ধরতে পেরেছি। তবে এও মনে হয়েছে যদি সে আরো একটু সময় বেশি নিয়ে বইটা শেষ করতো, তবে তা আরো বেশি সাবলীল হতো। চিমামান্দাকে অনুবাদ করার জন্য এবং বইটি পাঠক মহলে আনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই বীথিকে। প্রতিটা মানুষের এই বইটি পড়া প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে আমার।

‘উই শ্যুড অল বি ফেমিনিস্টস’ এবং ‘আ ফেমিনিস্ট ম্যানিফ্যাস্টো ইন ফিফটিন সাজেশনস’ – এই দুটো লেখাই নাইজেরিয়ার লেখক চিমামান্দা এনগোজি অ্যাদিচের, যার অনুবাদ বীথি’র করা ‘নারীবাদী প্রস্তাবনা’।

সারাবিশ্বে নারীদের অবস্থান কমবেশি একইরকম এবং নাইজেরিয়ার লেখক যা লিখেছেন, তা পড়ে মনে হচ্ছে উনি বাংলাদেশের মানুষের কথাই বলছেন, তাদের উদ্দেশ্যেই লিখেছেন। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নারীর অবস্থান এবং অবস্থা যেন একেবারেই অভিন্ন!
কিছু অগ্রসর হয়তো হয়েছে সংগ্রামের মাধ্যমে, কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গাতেই পরিবর্তন খুব সামান্য। চিমামান্দা যেভাবে বুঝিয়ে বলেছে বিষয়টা, যেভাবে উপস্থাপন করেছে – এর চেয়ে সহজভাবে আর কেউ বুঝিয়ে উপস্থাপন করতে পারবে বলে মনে হয় না এবং বীথিও এতো সুন্দর করে অনুবাদ করেছে যে আমি সত্যিই মুগ্ধ ও কৃতজ্ঞ।

১৫ টি পরামর্শ যেন একজন মানুষের জীবনকে সত্যিই সৌন্দর্যমণ্ডিত ও জীবনাচরণের সঠিক দিশা দেখায়—

১. একজন পূর্ণ ব্যক্তি হও…

২. নারী পুরুষ যৌথভাবে কাজ করো…

৩. লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ে সন্তানকে বড় করোনা, সন্তানের লিঙ্গের কারণে তাকে ‘এটা করো কিংবা ওটা করো না‘ বলো না…

৪. শর্তাধীন নারী সমতার ধারণাকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করো…

৫. বাচ্চাদেরকে পড়তে শেখাও, বই ভালোবাসতে শেখাও, প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে তাকে পড়ার নৈমিত্তিক উদাহরণ ও চর্চার মাধ্যমে জ্ঞ্যানি হতে সাহায্য করো…

৬. আমাদের কুসংস্কার, আমাদের বিশ্বাস, আমাদের অনুমানের ভাণ্ডার নিজের‘ভাষা‘কে প্রশ্ন করতে শেখাও…

৭. তাকে শেখাও একটা বিয়ে সুখী কিংবা অসুখী যেকোনোটা হতে পারে, কিন্তু ‘বিয়ে‘ কোন অর্জন কিংবা কৃতিত্ব নয়…

৮. অপরের কাছে নিজেকে পছন্দনীয় করে তোলার পরিবর্তে তাকে শেখাও পূর্ণ নিজস্বতা অর্জন করতে, নিজেকে এমন একটা সত্তায় পরিণত করতে যেখানে সে পছন্দনীয় হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে সততা এবং অন্যান্য মানুষের জন্য সমানভাবে মানবতা সম্পর্কে সচেতন হবে…

৯. সন্তানকে আত্মপরিচয়ের ধারণা দেও, তাকে তার সংস্কৃতির সৌন্দর্যকে ধারণ করতে শেখাও এবং কদর্যকে প্রত্যাখ্যান করতে শেখাও…

১০. কীভাবে সন্তানের/কোন মানুষের বাহ্যিক রূপ বিষয়ে আলাপ করছো, সেই বিষয়ে সচেতন হও, তাকে শারীরিকভাবে সক্রিয় হতে শেখাও, সবরকম খেলাধুলার মাধ্যমে তাকে নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে মুক্ত করে আনো…

১১. তাকে শেখাও মানুষ সামাজিক রীতিনীতি তৈরি করে এবং তা সবসময়ই পরিবর্তনযোগ্য। সংস্কৃতির শারীরিক ভিন্নতার বাছাইকৃত ব্যবহারকে সামাজিক নিয়মের ‘কারণ‘ হিসেবে প্রশ্ন করতে শেখাও। তাকে শেখাও জীববিজ্ঞান চমৎকার ও আকর্ষণীয় বিষয় তবে তাকে কখনোই সামাজিক আদর্শের ন্যায্যতা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না…

১২. তার সাথে যৌনতা নিয়ে কথা বলো- কখনোই যৌনতা এবং লজ্জাকে সম্পর্কিত করো না। শিশুরা তাদের সঠিক জৈবিক অঙ্গগুলোকে যথানামেই চিনুক এবং বলুক। কুমারিত্বকে কখনো ফোকাস করো না…

১৩. তাকে শেখাও প্রেম করতে সে অবশ্যই আবেগতাড়িত হবে এবং একইভাবে সে তার প্রেমিকের কাছ থেকে একইরকম আবেগ প্রত্যাশা করবে। তাকে বোঝাও প্রেম সম্পর্কে তুমি জানো এবং তাকে শিখিয়ে দেও – প্রেম কেবলই দেয়া নয়, গ্রহণ করাও। তাকে শেখাও দেয়ার ভূমিকা শুধু ছেলে কিংবা মেয়ের একার নয়, স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে কেউ দেয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে….

১৪. তাকে শেখাও, সাধুতা মর্যাদার পূর্বশর্ত নয়। নিপীড়নের বিষয়ে শিক্ষা দিতে গিয়ে কখনোই নিপীড়িতদের সাধুতে পরিণত করবা না। তাকে শেখাও যে সকল নারীই নারীবাদী নয় এবং সকল পুরুষই নারীবিদ্বেষী নয়…

১৫. তাকে পার্থক্য সম্পর্কে শেখাও, পার্থক্যের সাথে মূল্যায়ন যোগ না করতে শেখাও… তাকে তার নিজের মান বা অভিজ্ঞতাকে সার্বজনীন করতে শেখাবে না। তাকে শেখাও ভিন্নমত যতক্ষণ কারো ক্ষতি না করছে ততক্ষণ তাকে বৈধতার সাথে সম্মান করা যাবে। তাকে ননজাজমেন্টাল ও নিরহঙ্কার হওয়ার শিক্ষা দেও।
ছেলেমেয়ের ভেতর বৈষম্যের ধারা অনুচিত অন্যায্য হলেও বারবার দেখা আর জানার মাধ্যমে তা খুব সাধারণ হয়ে উঠে, যেখানে আমরা দোষ দেখতে পাই না, কিন্তু বৈষম্যের শিকার হয় বিশেষত নারীরা।
লেখক তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন নারী হওয়ার কারণে তিনি ক্লাস মনিটর হতে পারেন নাই, গাড়ি পার্কিং এ টিপস দিয়েও ধন্যবাদ পান নাই বরং ধন্যবাদ পেয়েছে তার পুরুষ বন্ধুটি। নারী হওয়ার পরও নিজের পছন্দের নারীর পোশাক যেমন স্কার্ট টপস না পরে কর্মস্থলে লেখক নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পুরুষের ন্যায় শার্ট প্যান্ট কোর্ট পরতে বাধ্য হয়েছেন। নারী হওয়ার কারণে একা লেখক কোন ক্লাব/বারে ঢুকতে পারেননি এবং পুরুষের সাথে ঢুকলেও লেখককে ওয়েটার অভ্যর্থনা না জানিয়ে বরং তার পুরুষ বন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এসব দেখে নারী বলেই লেখকের ক্ষোভ প্রকাশের অধিকারটাই যেন নেই, তাকে এসব মেনে নিতে হবে!

শামীম আরা নীপা

ক্ষমতার শিখরে নারীদেরকে কম পাওয়া যায়, পুরুষকে নারীর তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ন ভাবা হয় বিশ্ব চরাচরে। উন্নত অনুন্নত দেশ নির্বিশেষে আমরা ছেলেদেরকে দুর্বল হতে, ভেঙে পরতে ভয় পাওয়া শেখাই আর মেয়েদেরকে শেখাই ভয় পেতে সঙ্কুচিত হতে, আপোষ করতে।

নারীকে তার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়, নানামুখী চ্যালেঞ্জের শিকার হতে হয় এই পুরুষতান্ত্রিক জগতে। নারীবাদীকে বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক বলেছেন- একজন ব্যক্তি যিনি লিঙ্গ-নির্ধারিত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সাম্যকে বিশ্বাস করেন, তিনিই নারীবাদী।

‘অনুমতি‘ শব্দটাকে লেখক একটি সমস্যাপূর্ণ পুরুষতান্ত্রিক শব্দ বলে বিচার করেছেন যা সম্পূর্ণ যৌক্তিক। আমাদের এবং বিভিন্ন দেশের নারীরা তাদের সন্তানের বাবা থাকা সত্ত্বেও নিজেরাই বাচ্চার বেশীরভাগ দায়িত্ব পালন করেন, সেইসব মা‘দের উদ্দেশ্য করে লেখক বলেছেন- ‘তুমি সত্যিই একক মা না হলে তোমার ‘একা মা‘ হওয়া উচিত না।‘ – এই কথাটি খুব মনে ধরেছে আমার একজন পাঠক হিসেবে। এমন অনেক শব্দ বাক্য আছে এই নারীবাদী প্রস্তাবনা বইটিতে যা মানুষ হওয়ার পথকে নির্দেশ করে।

৪২ বছর বয়সের অভিজ্ঞতায় জানি চিমামান্দাও আমারই মতো আমারই সমাজে বড় হয়েছে এমন একজন।আমার নিজ জীবন থেকে লব্ধ জ্ঞ্যান ও অভিজ্ঞতার সাথে তার প্রতিটা কথার এতো সামঞ্জস্য যা মনকে একপ্রকার প্রশান্তি দিয়েছে যে আমি একা নই আবার দুঃখও হয়েছে যে নারীর দুর্ভোগের সীমা নাই এই জগতে।

সবগুলো কথা জানি, বুঝি, মানার চেষ্টা করি তারপরও এতো গুছানোভাবে এমন কথাগুলো আর কোথাও পাওয়া যাবেনা বোধ করি। বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে, নারী পুরুষের উদ্দেশ্যে তার পরামর্শগুলো অতুলনীয়।

বিশেষ করে তার অষ্টম পরামর্শ পড়ে আমি সবচেয়ে বেশি সম্পর্কিত বোধ করেছি লেখকের সাথে।
বীথি’র ‘নারীবাদী প্রস্তাবনা’ হয়তো কারো কারো কাছে নতুন কিছু বোধ হবে না, কিন্তু কারো কারো জন্য মহৌষধি হবে, সাহস বর্ধক হবে যদি পড়েন এবং উপলব্ধি করেন।

সবাইকে অনুরোধ করবো, বইটি সংগ্রহ করে পড়ার জন্য।

শেয়ার করুন: