জামাত-শিবির-রাজাকার ও ধর্মান্ধতা (১ম কিস্তি)

tania morrshedতানিয়া মোর্শেদের ডায়েরি থেকে: ডিসেম্বর ৪, ২০১২: জামায়াত-শিবির আজ যা করছে, তা একদিনের বা একজনের ভুলের জন্য নয়! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বেড়ে উঠবার কারণে সেই ‘৮০-এর দশক থেকে দেখেছি কীভাবে এরা কাজ করে!! তখন থেকেই মনে হতো দেশ কী পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে যাবে!

আজ টিভিতে যখন একজন ক্যামেরার ঠিক সামনে এসে চিৎকার দিয়ে বললো, “সারাদেশে আগুন ধরায় দেবো”, তখন থেকে মনে হচ্ছে এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সবার! অনেক অনেক বৎসর আগে বাবার সাথে তর্ক করতাম, বলতাম যে ১৯৭১-এ যখন তাঁর ছাত্ররা (মুক্তিযোদ্ধারা) ক্যাম্পাসে ঢুকবার পর রাজাকার শিক্ষকদের নামের লিস্ট চেয়েছিলেন, তখন কেন তাদের বিরত করেছিলেন তাঁরা যা করতে যাচ্ছিলেন তা থেকে? ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখছিলেন, বিবেকের তাড়নায় ভুগছিলেন, অস্ত্রহীন মানুষকে ক্ষমা করে উদারতা ও মনুষত্ব দেখাচ্ছিলেন আমার বাবা এবং তাঁর মত মানুষেরা! অথচ সেই রাজাকার শিক্ষকরা নয়টি মাস কী তাণ্ডব দেখিয়েছে পাকিস্তানী আর্মিদের সাথে নিয়ে।

বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি সেই রাজাকারদের আবার সক্রিয় হতে। সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই কীভাবে এতো ক্ষমাশীল ও ভুলোমন হয়! যাঁরা ১৯৭১ দেখেছেন তাঁরা যদি ক্ষমা করেন/ভুলে যান তাহলে যাঁরা ১৯৭১ পরবর্তী প্রজন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না তাদের কাছ থেকে কী আশা করবো?

সাত কোটি মানুষের মধ্যে ২০ থেকে ৪০ হাজার রাজাকার ছিল। আমাদের সবার ভুলের জন্য ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে রাজাকারদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষ কত কোটি আজ? ধর্মান্ধতার সুযোগ নিয়ে আজ কী পর্যায়ে তারা পৌঁছেছে! ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার, ধর্মান্ধতা নয়। আজ যেদিকে তাকাই ধর্মান্ধ মানুষই বেশি দেখি। ধর্মান্ধ মানুষের নিজেদের উপর আস্থা এতোই কম যে (যত উচ্চ শিক্ষিতই হোন না কেন), তাদের পীর স্থানীয় মানুষ লাগে ধর্মকে আশ্রয় করতে।

আর সেই সুযোগে  জামায়াত-শিবির-রাজাকার একেক জন পীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে “মগজ ধোলাই-এর কাজটি করে যাচ্ছে! উচ্চ শিক্ষিত মানুষরাই তা ধরতে পারেন না, তাহলে দরিদ্র্-অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মানুষ কিভাবে পারবেন?

ফেব্রুয়ারি, ২০১৩: জামাত-শিবির কিন্তু জানে তারা কি চায়। আমরা যাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ বলে দাবি করি, তারা কি সবাই জানি আমরা কি চাই?? যদি জানতাম তাহলে ৪২ বৎসর লাগতো না। এ প্রজন্মকে শাহবাগ চত্বরে এতদিন ধরে থাকতেও হতো না। শাহবাগে আসতেই হতো না। কেউ কেউ এখনো মনে করেন, রাজাকারদের বিচার চান, কিন্তু জামাতের রাজনীতি করবার অধিকার আছে। রাজাকারদের বিচার চান, কিন্ত নামকরা আইনজীবী (বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের একজন নামকরা মানুষের জামাতা) রাজাকারদের পক্ষে ওকালতি বা লবিইং করলে অসুবিধা নেই। বিচার চান, কিন্তু রাজাকারদের বন্ধু-সহোদরদের চিহ্নিত করা যাবে না। করলেই অপরাধ।

মানবতার গান গেয়ে জামাত-শিবিরের সাথে কোলাকুলি করে থাকো। কেন? সব মুসলমান ভাই ভাই। যদি পাকিস্তানীরা মুসলমান না হয়ে অন্য যে কোনো ধর্মের হতো, ১৯৭১-এ একটিও রাজাকার থাকতো না বাংলাদেশে। আর জামাত-শিবির যদি মুসলমান না হয়ে অন্য ধর্মের হতো, এই সব বাংলাদেশীদের কোনো অসুবিধা হতো না, যত কঠিন কথাই বলা হতো জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে!

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৩: আজ জামাত-শিবির সব জায়গায় তাদের স্থান করে নিয়েছে, প্রবাসেও সব জায়গায়। অনেক সময় অনেক কিছুই এদের সাথে যুদ্ধ করেই করতে হয়। ওদের বেশির ভাগই বর্ণচোরা। সাধারণ বাংলাদেশীরা ধর্মভীরু (এটি তাদের ব্যক্তিগত অধিকার/বিষয়)।

আর জামাত-শিবিরের কাজই হচ্ছে ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা। সাধারণ বাংলাদেশীরা বেশির ভাগ সময় এদের কূটচাল বুঝতেই পারেন না। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে বার বার জামাত-শিবির ফায়দা লোটে।

মার্চ ১৩, ২০১৩: এক দেশে এক চিমনি দিয়ে সাদা না কালো ধোঁয়া দেখা যাবে তা নিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ চিন্তিত ছিলেন। চিন্তার দিন শেষ। আরেক দেশে চিন্তার দিন নয়, রীতিমতো যুগ আর শেষ হয় না! চাঁদে চাঁদের মা বুড়ির জায়গায় এক পীরের ছবি দেখা যায়! যে ধর্মকে পৃথিবীর কেউ ধ্বংস করতে পারবে না বলা আছে (সেই ধর্মগ্রন্থে), সেই ধর্মকে রক্ষা করবার জন্য এক হেফাজত বাহিনী গঠন করা হয়।

তাহলে কি ধর্মগ্রন্থে পুরো বিশ্বাস নেই? অথচ সেই ধর্মেই বলা আছে, সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে, কোনো প্রশ্ন ছাড়া। সেই হেফাজত বাহিনী যে আরেক ধর্ম বেচা দলেরই অংশ, তা বোধ হয় শিশুরাও বুঝবে। হেফাজত বাহিনীর কবল থেকে হেফাজত করবার দোহাই দিয়ে সরকার কি চাল চালছে তা বুঝবার চেষ্টা করা দরকার সবার।

সব ধর্মকে হেয় করে কথা বলা যাবে, ইসলাম বাদে! আহা আজি কি আনন্দ জামাতী-শিবিরের! রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, কিন্তু দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ, সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” থাকবে, কিন্তু দেশ ধর্ম নিরপেক্ষ। সেরকমই ইসলাম ও মুহাম্মদ নিয়ে কিছু বলা যাবে না, যদি নিষেধাজ্ঞা দিতে হয় (?) তবে অন্য ধর্মের বেলায় নয় কেন? ধর্ম নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা হরণ (যে কোন বিষয় নিয়েই কথা বলার স্বাধীনতা হরণ) হবে কেন? এই সরকার কাদের খুশি রাখতে চায়? তাদের ভোট কখনোই তারা পাবে না, এটা কি জানা নেই?

প্রজন্ম চত্বর যদি রুখে না দাঁড়ায়, তাহলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সুযোগ আর পাবে না। ৪২ বৎসরে ২০-৪০ হাজার রাজাকারের ঘরেই শুধু জামাত-শিবির জন্মায়নি, ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান/ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের সন্তানদেরও মগজ ধোলাই করছে। তাই তো এত রাজাকারের দোসর-জামাত-শিবির দেখি সব জায়গায়!

মার্চ ২৩, ২০১৩: বাংলাদেশীদের মধ্যে আস্তিক-নাস্তিক “কার্ড” ব্যবহার করে যে যার মত (জামাত-শিবির-বিএনপি-সরকার) ফায়দা লুটছে/ লুটবার স্বপ্ন দেখছেন। দেশপ্রেম আর ধর্মীয় অনুভূতি এক বিষয় নয়।

ধর্মের নামে ১৯৭১-এ যে সব বাংলাদেশী পাকিস্তানীদের সাথে এক হয়ে নিজের দেশের সাথে/ নিজের দেশের মানুষের সাথে অন্যায়, নির্মম অত্যাচার করেছে তাদের বেশীর ভাগই ধার্মিক। কিন্তু তারা তো দেশদ্রোহী, মানবতা বিরোধী। আমার একথায় অনেকেই তর্ক জুড়বেন যে, তারা প্রকৃত ধার্মিক নন! কিন্তু তারা (রাজাকার) তো বিশ্বাস করে তারা ধার্মিক। তারা নিয়ম করে ধর্মের সব পালন করে, অন্যকে ধর্মের জ্ঞান দান করে, কে “মুসলমান” নয় তার ফতোয়া দেয়। আর বাকী ধর্মভীরু বাংলাদেশীরা তাদের হুজুর হুজুর করে, দেশে কী বিদেশে। বিদেশে (তাদের ভাষায় ইহুদী/ নাসারাদের দেশে) সব সুবিধা ভোগ করে, ইহকালের সব ভোগ করে, পরকালের রাস্তা ঠিক রেখে (ধর্মের সব কিছু নিয়ম মত পালন করে), অন্যকে নাস্তিক ঘোষণা দেয়, কল্লা কাটা বাহিনীর হয়ে তর্ক করে, কেউ কেউ লুকিয়ে সমমনাদের নিয়ে গ্রুপিং করে, আরো কিছু করে নিশ্চয় (রাজাকারদের রক্ষার্থে এত টাকা আসে কিভাবে), কোনো কোনো জায়গায় আবার প্রকাশ্যে রাজাকারদের পক্ষে বা রক্ষায় লবিইং করে, প্রয়োজনে রাস্তায় নামে! বাকী অনেক বাংলাদেশী মুসলমান নিজেদের দেশপ্রেমিক দাবি করেন কিন্তু তাদের সাথে বন্ধুত্ব রাখেন, কেউ কেউ পীর ভাবেন (ধর্মের উপর অনেক জ্ঞান থাকা মানুষকে কেন জানি মানুষ “পীর” ভাবতে পছন্দ  করেন, যদিও ইসলাম ধর্মে পীরের প্রয়োজন আছে বলে জানি না, পীর ভক্ত হওয়া ধর্মের সাথে না যাওয়ার কথা)!

সরকার যে ভূমিকা পালন করছে, জামাত-শিবির নিষিদ্ধ না করা, ব্লগারদের পিছনে লাগা, (নাস্তিকতার ধুয়ো তুলে, যা বাকস্বাধীনতা হরণ), নিজেদের ধার্মিক প্রমাণে ব্যস্ত হওয়া, এসব কিছুই প্রমাণ করে যে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হয়েও আজ ভোটের রাজনীতিতে ধর্মবিশ্বাসী দলে পরিণত হয়েছে (অনেক আগেই, আজ তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার)।

(বিএনপি নিয়ে কিছু বলছি না দেখে কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগলে বলছি, আমার শক্তি (এনার্জি) বা সময় ব্যয় করবার আরো অনেক বিষয় ও জায়গা আছে)।

সব দেখে মনে হচ্ছে, ১৯৭১-এ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন (জীবিতদের মধ্যে যাঁরা আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারাননি, খুব খুব মর্মাহত হয়েই এই বাক্য লিখছি) তাঁদের যদি আবার মুক্তিযুদ্ধের জন্য ডাকা হয় তাহলে ক’জন আসবেন? কেন আসবেন?

আজও আমি কেন খবরের কাগজে পড়লাম যে, ৩২টি জেলায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার হয়েছে (২৩ শে মার্চ) পর্যন্ত। ‘শান্তির ধর্ম ইসলাম’ বলে যারা সারাক্ষণ নাস্তিকদের/ কাফেরদের জ্ঞান দেন তারা এবার প্রমাণ করে দেখান যে, ইসলাম সত্যিই শান্তির ধর্ম। কি ভাবে? নিজের বাড়ি থেকে শুরু করেন। নিজে শেখেন, নিজের সন্তানদের শেখান, “সবার উপরে মানুষ সত্য”, “আগে মানুষ তারপর মুসলমান, হিন্দু ………………।” নিজের বাস যেখানে, খেয়াল করুন যারা সংখ্যালঘু ((অপছন্দের শব্দ) যে বিষয় বা কারণেই হোন না কেন) তাদের সাথে কোনো মানুষ  বা দল খারাপ আচরণ করছে কিনা, করলে প্রতিবাদ করুন। দয়া করে নিজে যে মানুষ হয়ে জন্মেছেন তা প্রমাণ করুন!

এপ্রিল ১, ২০১৩: ধর্ম মানুষকে আলোর পথে নেবে, যে সব মানুষের নিজের সুচিন্তা, সুবোধ করবার শক্তি ততটা পরিষ্কার নয়/ যাদের অন্যের দিক নির্দেশনা (গাইডেন্স) প্রয়োজন তাদের জন্য ধর্মের অনুশাসন ……… এভেবেই তো ধর্মের সৃষ্টি। তাহলে ধার্মিক মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে পেটানো দেখে খুশী হয় কিভাবে? ধর্মানুভূতির ভিৎ এত ঠুনকো হয় কি করে যে, নাস্তিক মানুষকে/ ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করা মানুষকে ফাঁসি দেবার কথা ভাবে! আবার অন্য ধর্মের বিষয়ে নিজে কটুক্তি  করতে ছাড়ে না! কল্লাকাটা/ রগকাটা মুসলমানদের কিছু না বলে নাস্তিকদের ধরছে, এরা কয়জনের কল্লা/ রগ কেটেছে? বাংলাদেশ কি পাকিস্তান/ আফগানিস্তান হবে এই সরকারের আমলেই?

শেয়ার করুন: