ভালো মেয়ের লক্ষণরেখা!

সালমা লুনা:

আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে একদিন দুপুরে আনন্দমোহনে আমার ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে আছি। একটা খুপড়িমতো জায়গা ছিলো, ওদিক দিয়ে নিচের বারান্দায় দাঁড়ানো সহপাঠী কয়েকজনকে দেখছি। তারা খুব সিরিয়াস হয়ে গল্প করছে।

আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপলো – একটা কিছু করে ওদের চমকে দেয়া যায় কীনা! ঝুঁকে দাঁড়াতেই হঠাৎ শুনলাম ত্রিশালের একটি ছেলে, যাকে তখন বন্ধু বলেই জানতাম, সে আরেকজনের সাথে আমার নাম ধরে বলছে – আরে থো বেডা! হে তো প্রেম করে। আর না করলেই কী! দেহসনা বেডা হের পেছনে দশটা পোলা সমানে ঘুরঘুর করে, হে একটা ‘বাজে মেয়েলোক’!
এবং আরও একটা বিশেষণ ব্যবহার করেছিলো। যেটি আজ আর উল্লেখ করতে চাই না। করার মতো নয় বলে।

সালটা কোন প্রাগৈতিহাসিক সময় না, মাত্র ৯৪ এর ঘটনা। পদার্থ বিজ্ঞান স্নাতকের একজন ছাত্র – চলনে বলনে এক আধুনিক ছেলে,তারই সহপাঠী এবং বন্ধু সম্পর্কে এইরকম মন্তব্য করতে পারে, খুব অবাক হয়েছিলাম।
অবশ্য এরপর আমি নিজেকে ওই ছেলেটি থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। সে এখন শুনেছি কলেজে পড়ায়। আমি জানি না তার মানসিকতার কদ্দূর কী পরিবর্তন হয়েছে! তার সাথে এখন কোনো যোগাযোগ নেই , ইচ্ছেও হয়নি কখনো যোগাযোগের।

সালমা লুনা

হ্যাঁ, আমার তখন প্রেম তো ছিলোই।
আর পেছনে ঘুরঘুর?
সে তো ছোট্ট শহরে থাকা যেকোন সুশ্রী মেয়ের জীবনে ডালভাত ! কলেজেও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা। পুরোদমেই এই কর্ম চালিয়ে যায় ‘ভালো ছেলেরা’। নিজ ডিপার্টমেন্টের ভালো ছেলেরা ছাড়াও অন্য ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইরাও নতুন সুন্দর মুখ দেখতে ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে ঘুরাঘুরি করে। সুযোগ পেলে নিজের বাসনা টাসনাও জানিয়ে যায় কখনো।

আমাদের মতো বাজে মেয়েরা তখন একা তাদের সামলাতে না পারলে বন্ধুদের সাহায্য নিয়েছি হরহামেশা। এমনকি তারাও কেউকেউ অবস্থা বেগতিক দেখলে নিজে থেকেই এগিয়ে এসেছে। তা বলে আড়ালে এরাই আমাকে নিয়ে এসব ভাবে! এমন কদর্য মন্তব্য করে! নিজ কানে এসব শুনে পায়ের নিচে মাটি সরে যাওয়া কিংবা বমি বমি ভাব – কিছু একটা হয়েছিলো। বিষয়টাতে খুব আহত হয়েছিলাম।
জানা ছিলো মেয়েদের দোষ বেশি। তাই বলে পেছনে ভালো ছেলেরা ঘুরঘুর করলে সেই নারীই খারাপ?

এই ধারণার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। আমার সেই সহপাঠী এই সমাজের একটা বৃহৎ অংশের মুখপাত্র মাত্র। সেদিন না বুঝলেও আজ হাড়ে হাড়ে বুঝি।

আসলে এদেশে ভালোমেয়ের একটি লক্ষ্মণরেখা থাকে যা পার হলে চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায়।

বাঙালি পুরুষ মাত্রই নারীকে কী ভাবে , বা তাদের কীভাবে কী চোখে দেখে আমরা নারীরা কমবেশি জানি। এগুলো মোটামুটি আমাদের শৈশবেই জানা হয়ে যায় । তবু বিন্ধু ভেবে রাখা কারো কাছ থেকে এভাবে জানাটা একটু থমকে দেয় বৈকি !

অনেক অনেক অনেক বছর, বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে এই ধারণার কোন পরিবর্তন আসেনি। বলাবলি, লেখালেখি চলছে, আলোচনা আয়োজনে উঠে আসছে এসব কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে কি?

বাবা, ভাই, বন্ধু, সহকর্মী, স্বামী যে রূপেই পুরুষ নারীর জীবনে থাকুক বা আসুক সবার চোখেই নারীর একটা গৎবাঁধা রূপ আছে। বলা চলে এটি সেই পুরুষটিরই নিজের গড়া রূপ। সে কন্যা বোন বান্ধবী সহকর্মী বা স্ত্রীকে সেই রূপের বাইরে দেখতে ইচ্ছুক না। এটাই নারীর লক্ষ্মণরেখা। এর বাইরে গেলেই তার প্রতি বিরূপ। তাচ্ছিল্য কিংবা রুদ্ররোষ। চলে নামকরণের পালা।

মজার ব্যাপার হলো, এই লক্ষণরেখা টানার একছত্র অধিকার শুধু পুরুষের না নারীর হাতেও থাকে। হয়তো প্রচ্ছন্ন প্রভাব পুরুষের থাকে তবে নারী নিজেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নারীর বিচরণের গণ্ডি নির্ধারিত করে দেয়। যার সূত্রপাত ঘটে পরিবারে। এরপর ধাপে ধাপে চলে সকল স্তরে।

নারীরা যারা এই রেখা একবারেই মেনে নেয়, তারা বেঁচে যায় বলা চলে। ঝামেলাহীন জীবন। তারা ভালো নারী।

যারা শুরুতেই মানে না তাদেরও আরেক ধরনের বেঁচে যাওয়া। তারা সময়ের সাহসী মানুষ, মেরুদণ্ড সোজা। অথবা এ ‘গন কেস’!

এই দুই দলের সমস্যা কম।

সমস্যা তাদের বেশি যারা সব বোঝে জানে। অথচ না পারে লক্ষণরেখার বাইরে অনায়াস বিচরণ করতে। না পারে ভেতরে থাকতে। কোন কিছুর সাথেই মিলতে আর মিলাতে পারে না।

এই সংখ্যাটাই অনেক !
বলা চলে খুব বেশিই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.