শিপা সুলতানার ‘পালকের ব্লাউজ’ এবং হরেক রকম পালক

মোহছেনা ঝর্ণা:

“তরে লইয়্যা এমন জাগাত যাইমু সাধু, এমন জাগাত…. এমন জাগাত যে…..”

— গতকাল থেকে এই লাইনটা শুধু মাথায় ঘুরছে। কী মোহনীয় আবাহন! কী আকুল করা সম্মোহন!

সোনাভানের জন্য এই আয়োজন। আয়োজক অবশ্য আমি নই। আয়োজক সোনাই সাধু। সোনাভান এই আকুল করা আবাহনকে খুব একটা কেয়ার করে না। আসলেই কি কেয়ার করে না!

তা না হলে কেন এমন হবে? কেন কবর খোঁড়ার জন্য মাটিতে কোদাল বসবে না? কেন পাথরে বাড়ি খেয়ে কোদাল ফিরে আসবে? কেন দাদাজী এই ঘোষণা দিবে, যে যেভাবে পারুক সোনাইকে খূঁজে আনুক, সোনাই ছাড়া সোনাভানকে মাটির তল করা যাবে?

বলছিলাম গল্পকার শিপা সুলতানার গল্পগ্রন্থ “পালকের ব্লাউজ” এর “সোনাই সাধু” গল্পের কথা। শিপা সুলতানা বৈঠকি ঢংয়ে চমৎকার চমৎকার সব গল্প বলেন। তার গল্প যখনই পড়ি, মনে হয় কেউ একজন গল্প বলছে, আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি।

“পালকের ব্লাউজ” গল্পে সিলেটি ভাষাটা কী মায়াবী ভাবে বলে গেছেন গল্পকার!
“: তুমি হাসর ফৈড় দিয়া কিতা করতায় আফিয়া?
: জমাইতাম, জমাইয়া একটা ব্লাউজ বানাইতাম, আর হুনো কমল ভাই, তুমার সবতাত কেনে অত আগ্রহ? খালি বেটিনতর মাতো থাকো, বাড়িত যাও!”

শিপা সুলতানা থাকেন প্রবাসে। কিন্তু তার সবগুলো গল্পেই লেগে আছে মাটির ঘ্রাণ। তার জন্মভূমির ঘ্রাণ। কী কথায়, কী প্রকৃতির বর্ণনায়, কী আত্মীয়তার মায়ায়…..

তার গল্প থেকেই তুলে দেই সেরকম মায়াবী কিছু অংশ।
“কে জানে কী হয় অগ্রাণের চাঁদে, শরীর ভেদ করে আলো এসে ঢুকে পড়ে রক্তের ভেতর, জানালা বন্ধ করার মুহূর্তে কমল ভাইয়ের কী যেন এক ছায়া চোখে পড়লো তার, কিন্তু কমল ভাই কই? ঐ যে আলোর ভেতর শিমুল তুলার মতো উড়ে উড়ে ভরশূন্য হেঁটে যাচ্ছে যে ছায়া, ওটা কমল ভাই? কিন্তু কোথায় ছুটে যাচ্ছে সে! আফিয়া নিজের ভেতর মরণ চিৎকার দিয়ে হাঁটু ভেংগে মেঝেতে বসে পড়ে। কমল যে রেখা ধরে হেঁটে যাচ্ছে, তার কোনো গন্তব্য নেই, ভিটামাটি নেই, ভাংগা বাসন, বাতিল টিন লোহা লক্কর ফেলার সাড়ে তিনশ ফুট এক গভীর খাদ…”

পত্রসখা গল্পের একটা ঘোর আছে। বীণা নামের মেয়েটি সেই ঘোরে আচ্ছন্ন হয়। বীণাদের শহরের ডিসি ভদ্রলোক যিনি বীণার পত্রসখা। যার চেহারার সাথে বীণা মিল পায় বলিউডের নায়ক হৃত্বিক রোশনের। তার অফিসের টেবিলে কোণায় পাতা, ড্রয়ারের ভেতর পাতা, আলমারিতে দরকারি ফাইলের ভেতরে পাতা, পাতার রাজ্যে যেন তিনি এক পত্রকুমার। বীণা নিজের অজান্তেই কখন যে সেই পত্র কুমারের প্রতি দুর্বল হয়ে যায়। আর যখন জানতে পারে সেই পত্র কুমারের স্ত্রী আছে, সংসার আছে তখন থেকেই বীণার যেন কি হতে থাকে। হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে, নরমাল টেম্পারেচারের ঘরেও হঠাৎ প্রচন্ড শীত শীত লাগে….
জগতে সব ভালোবাসার উৎসমূল উদঘাটন করা সম্ভব হয় না, ঠিক তেমনি কিছু ভালোবাসার নীরব বিসর্জনেরও কোনো ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। তাই তো বীণা আর পাতা কুড়ায় না। “কোন পাতাটি আপনি” সেই পাতাটি বীণা হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে নিজেকেও। আর তখনি পাঠক আমি একাত্ম হয়ে যাই বীণার সাথে।

পালকের ব্লাউজ গল্পগ্রন্থে নয়টি গল্প আছে।
পত্র সখা, ময়না ভাই, মধুবউসহ সব গল্পতেই আছে গল্পকারের জন্মভূমি সিলেটের মায়া। আছে গাছ- পালা, নদী, হাওড়, বিল, পাখপাখালি। আছে মিথ। কাঁঠাল পাখির মিথ। আছে পাহাড়। ছাতলার পাহাড় নামটা মাথায় গেঁথে গেছে। পাহাড়ের নামটাও কী সুন্দর! ছাতলার পাহাড়!

মোহছেনা ঝর্ণা

গল্পকারের জন্য শুভকামনা। নিশ্চিত করে বলতে পারি, তার পাঠকরা দারুণ কিছু সময় কাটাবে “পালকের ব্লাউজ” এর সংগে।

চট্টগ্রামের বই মেলায়, চন্দ্রবিন্দু স্টলে পাওয়া যাচ্ছে “পালকের ব্লাউজ”।

 

নিজের গল্প সম্পর্কে গল্পকার শিপা সুলতানা’র মূল্যায়নটুকুও বেশ ভাবনার খোরাক দেয়।

“একটা বিন্দু ধরে শুরু করি। কথার পিঠে কথা আসে, যেহেতু গল্প, গল্পই তো বলতে চাইছি। আমার ভেসে থাকার স্বভাব। স্বপ্নে প্রায়ই আমি ভেসে থাকি। যখন লিখতে বসি, খানিকটা হলেও ভাসমান থাকি। চরিত্রগুলোকে সেভাবে ছেড়ে দিই। ভাসতে ভাসতে তাদের যেখানে ইচ্ছা যাক। প্রথমদিকে এক বসাতে লিখতে না-পারলে কখনোই সে-গল্প আর লিখতে পারতাম না। এখন একাধিক বার বসি। চেনাজানা ভাষা, যার ভেতর আমি অনায়াসে গড়াগড়ি দিতে পারি, তেমন ভাষা, ভাব ভঙ্গিই বেছে নিই।

…এই যে নিঃশ্বাস নিচ্ছি, তখনও কোটি কোটি গল্প তৈরি হচ্ছে চারপাশে। আমি শুধু কিছুটা টুকে রাখছি। এর বেশি কিছু নয়। সমস্যা শুরু হয় ছাপা হওয়ার পর। এতো বিব্রত, এতো লজ্জিত হই, মনে হয় কাগজ কলমের অপচয়। এ-কষ্ট বলে বুঝানোর নয়।…আমি প্রচুর কথা বলি, যখন বলি সবাই শুনে এবং গল্প বলা শেষ হলে বলে মিথ্যে মিথ্যে বলেছি। আমি কেনো মিথ্যে মিথ্যে বলতে যাবো? আমি যা দেখি, যেভাবে দেখি, বস্তুর ভারসাম্য, রঙের তারতম্য, সেভাবেই তো বর্ণনা দেব। যখন কথা বলি না, তখন লিখি, নিজের জন্য। নিজের সাথে নিজের কথা বলার মতো। লেখা শেষ হলে ভাবি গোপন এই কথাগুলো কি কাউকে বলা যায় না? তখনি কেবল পাঠকের কথা মনে হয়।”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.