হিজাব পরিহিতরা কি নারীবাদি নন?

নাসরীন রহমান:

সাম্প্রতিকসময়ে নারীবাদিদের মধ্যে একটি বিতর্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে হিজাব পরিহিতরা কি নারীবাদী? নাকি নারীবাদী নন? সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, হিজাব পরে নারীবাদের চর্চা করা যায় কিনা?
বা হিজাব পরিহিতদের আসলেই কি নারীবাদী শ্রেণিভুক্ত করা যায় কিনা?

র‌্যাডিকেল নারীবাদীদের অনেকেই হিজাব পরিহিতদের নারীবাদীদের কাতারে ফেলতে নারাজ! তাদের মতে, হিজাব পরিহিত নারীবাদীরা আসলে নারীবাদীই নন, তারা দুই কূল রক্ষা করে চলছেন।

সোশ্যাল নারীবাদীরা ভাবেন, হিজাব পরিহিতরা নারীবাদী বটে, তবে একই সাথে তারা হিজাবের খুব একটা পক্ষপাতীও নন।
নারীবাদীদের নিয়ে এই বিতর্ক অবসান ঘটাতে আসলে নারীবাদ বা নারীবাদীদের সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেমন বিভিন্ন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে নারীবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়, তেমনি নারীবাদীদের রয়েছে নানান রকমফের।
একজন নারীবাদীর নারীবাদী হয়ে গড়ে উঠার পেছনে রয়েছে তাঁর নিজস্ব কিছু চিন্তাধারা, উপলব্ধি, যোগ্যতা।

একজন নারীবাদিকে মূল্যায়ন করতে হবে তার কাজ, চিন্তাধারা, মূল্যবোধ দিয়ে, পোশাক দিয়ে বিচার করে নয়।

দেখা যাচ্ছে একজন নামায, কালাম পড়ুয়া নারী যিনি কিনা ব্যক্তিজীবনে পুরুষতন্ত্রের দ্বারা নিপীড়িত হতে হতে একদিন হয়ে উঠতে পারেন প্রচণ্ড প্রতিবাদী, তখন আমরা কিন্তু তাঁকে নারীবাদি আখ্যা দিতে পারবো কারণ নারীবাদ কিন্তু প্রতিবাদ বা সংগ্রাম করছে পুরুষতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার
বিরুদ্ধেই। সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। এক্ষেত্রে ওই নারীর পারিপার্শ্বিক অবস্থাই তাকে পরিণত করেছে নারীবাদী রূপে; এখানে পোশাক ব্যাপার নয়।

আসলে ফেমিনিজমের নানা ধরন আছে। নানা পথ, মত আছে। কে কোন পোশাকে নারীবাদ চর্চা করবেন, তা তার একান্তই নিজস্বতা; এ নিয়ে কারো কিছু বলা মানে নারীবাদ মানে পুরো আন্দোলনটাকেই খাটো করা বা প্রশ্নবিদ্ধ করা।

যেমন নারীবাদিদের কেউ যদি চুল ছোট রাখেন, জিনস পরেন, স্মোক করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেটা তার ব্যক্তিগত, এর জন্য আমরা জিনস পরা, স্মোক করা সেই নারীবাদিকে খারিজ করে দিতে পারি না। তিনি হয়তো এভাবেই তার প্রতিবাদ করছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, ফেসবুকে একজন নারীবাদী একবার তার সুন্দর সিল্কি লম্বা চুল কেটে বয়কাট করে পোস্ট দিয়েছিলেন, ‘চুল কেটে প্রতিবাদ করলাম’।

এই ব্যাপারটিকে কীভাবে নিবেন?

আমি তো বলি একজন নারী সে যখন তার স্বামীর এতোটুকুও অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, সেই মুহূর্তেই তিনি হয়ে উঠছেন একজন নারীবাদী। তিনি তার ঘরেই প্রতিবাদ করছেন পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এখানে পোশাক কিন্তু মুখ্য নয়, বরং তাঁর প্রতিবাদই তাকে পরিণত করেছে নারীবাদী হিসেবে।

সুতরাং কে কী পোশাক পরলো, হিজাব পরলো কী পরলো না তা নয়, বরং দেখতে হবে তিনি আদর্শিকভাবে নারীবাদ তার কাজে, কথায় প্রকাশ ঘটাচ্ছেন কিনা! নারীবাদকে লালন-পালন বা ধারণ করছেন কিনা!
পোশাক, হিজাব, জিনস এসব কখনো নারীবাদের পরিচয় বহন করে না।

এখন দেখা যাক, হিজাব কেন র‌্যাডিকেল নারীবাদিরা সমর্থন করেন না। তাঁদের অনেকের মতে, হিজাব পরা এক ধরনের ডিস্ক্রিমিনেশন; নারী ভোগ্যপণ্য তাই নারীর চেহারা ঢেকে রাখতে হবে এই ধারণাকে পাকাপোক্ত করে হিজাব। অনেকে বলেন, এটা পুরুষশাসিত ড্রেসকোড, তাই হিজাব তারা সমর্থন করেন না।

এই বিষয়গুলোর সমাধানে আসতে হলে প্রথমে জানতে হবে এই যে হিজাব পরছেন নারী তা কি নিজের ইচ্ছায় নাকি প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় মূল্যবোধকে লালন করতে? যদি দ্বিতীয় বিষয়টি হয় তবেই এখানে বলার থাকে, হ্যাঁ, এই হিজাবধারী নারীবাদী নন, কারণ তিনি পুরুষতন্ত্রের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু
যদি প্রথম কারণটি হয়, সেক্ষাত্রে বলার কিছু নেই, কারণ পোশাক পছন্দ করার স্বাধীনতা প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার, কেউ কারো পছন্দের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।

আপনি যদি নির্দ্দিষ্টভাবে বলে দেন, হিজাবপরিহিতরা নারীবাদী নন তবে কিন্তু আপনি নারীর স্বাধীন নির্বাচনের ক্ষমতাকে খর্ব করছেন যা নারীবাদের সাথে সাংঘর্ষিক।

পরিশেষে প্রখ্যাত নারীবাদী, সমাজ সেবী, উন্নয়নকর্মী, কবি, লেখক কমলা ভাসিনের একটি মন্তব্য দিয়ে লেখা শেষ করছি; তিনি বলেছেন, ‘নারীবাদিরা যে যেভাবেই বলুক, তাদের সবার উদ্দেশ্য তো একটাই- পুরুষতন্ত্রকে আঘাত করা এবং বদলানো। যে যেভাবে তা চর্চা করুক। কেউ ছেঁড়া প্যান্ট পরে করে। আমি
দোপাট্টা পরে করি। এটাই তো মজা।’

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.