আপনিও কি খুনি?

শান্তা মারিয়া:

সাম্প্রদায়িকতা এমন এক দানব যা রক্তবীজের চেয়েও ভয়াবহ। এই দানব বাড়ে প্রশ্রয়ে, বাড়ে সচেতন মানুষের নীরবতায়। আপনি ভাবতে পারেন, ‘ দিল্লিতে যে মানুষগুলো মরছে, আমি তো তাদের মারিনি।’ কিন্তু আপনি যখন মোদী-অমিত শাহ গংকে ভোট দিয়েছেন, আপনি যখন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সমর্থন দিয়েছেন, যখন আপনি ‘মুসলিম’ মরার সংবাদে গোপনে খুশি হয়েছেন, যখন আপনি ‘হিন্দু’ মরার সংবাদে গোপনে খুশি হয়েছেন, যখন আপনি মন্দির ভাঙ্গার সংবাদে নিশ্চুপ থেকেছেন, যখন আপনি মসজিদ ভাঙার সংবাদে নিশ্চুপ থেকেছেন, তখনই কিন্তু নিহত মানুষের রক্ত আপনার হাতেও লেগেছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হত্যা, দিল্লিতে সংখ্যালঘু হত্যা, পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হত্যা সবটাই অপরাধ। সবটাই অতি ঘৃণ্য, ঘৃণ্য, ঘৃণ্য অপরাধ। যখনই আপনি ধর্মীয় বিদ্বেষের বার্তা ছড়ান (সেটা যে ধর্মেরই হোক) তখনই কিন্তু খুনিদের হাতকে আপনি শক্তিশালী করেন। যখনই আপনি নিজের শিশুকে অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করতে শেখান, তখনই কিন্তু আপনি একজন হত্যাকারীকে সৃষ্টি করেন।

শান্তা মারিয়া

১৯৪৭। দেশভাগ। দাঙ্গা। হত্যা। ধর্ষণ। লুট। এসবই উপমহাদেশের প্রতিটি মানুষের জন্য কলংক, বেদনা। আমি নিজে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা এক পরিবারের মেয়ে। আমার দাদা ঢাকায় এসেছিলেন ১৯২১ সালে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর আমাদের বহু আত্মীয় স্বজন পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে আসেন ভিটেমাটি ছেড়ে। রিফিউজিদের কষ্ট আমি দেখেছি।

আবার বিপরীতক্রমে পূর্ববঙ্গ থেকে সব হারিয়ে কেবল প্রাণটুকু সম্বল করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাওয়া অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। তাদের বেদনাও আমি মর্মে মর্মে অনুভব করি।

আমার নিজের কাছে মনে হয় আমার কোনো ঘর নেই। ভিটেবাড়ি বলে কিছু নেই। একশ বছর ধরে আমার পরিবার ঢাকা শহরে বাস করছে। তবু আমি আজও তো ঢাকাইয়া হতে পারিনি। আবার আমি কি চব্বিশ পরগনার বশিরহাটের মেয়ে? তাও তো নয়। ‘আই বিলং নো হোয়্যার’। আমার মতো অসংখ্য মানুষ আছেন। এই সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু যুদ্ধে আমার নিজেকে প্রায়ই অসহায় মনে হয়। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আসলে কোন দেশ নেই, ভিটেবাড়ি নেই। ক্ষমতাশালীরা অনেক আগেই সেসব খুবলে খেয়েছে।
আমার মতো ভিটেহারানো মানুষ আছেন বাংলাদেশে, আছেন দিল্লিতে, আছেন ভারত ও পকিস্তান, বাংলাদেশের সর্বত্র। আমাদের সবকিছু পুড়ে গেছে ১৯৪৭ এ। আমি দেশভাগ মানি না। আজ যাদের হত্যা করা হয়েছে দিল্লিতে, তাদের প্রকৃত ঘর পুড়ে গেছে, তারা হত হয়েছে ১৯৪৭ এই।

যে ঘাতকরা তাদের হত্যা করেছে তারা হিন্দু নয়, তারা কেবলই ঘাতক। তারা ছিল গুজরাটে, নোয়াখালিতে, বিহারে, পাঞ্জাবে। ঘাতক কখনও হিন্দু বা মুসলিম হতে পারে না। তারা কেবলই ঘাতক। এরা রক্তবীজ। এদের প্রতিহত করুন। ধর্মীয় উগ্রতা এরা ছড়িয়ে দেয় শুধু নিজেদের স্বার্থে। মোদীর মতো অমানুষরা শুধু ধ্বংস করতেই জানে। এরাই রাক্ষস।

যারা মন্দির ভাঙে, যারা মসজিদ ভাঙে তারা সকলেই মোদী, সকলেই উগ্র হিন্দু, উগ্র মুসলিম নামধারী অমানুষ।

আমি ভারতের ভাইবোনদের বলি, বাংলাদেশের ভাইবোনদেরও বলি, আসুন, আমরা সকলে মিলে এই সাম্প্রদায়িক অমানুষদের প্রতিহত করি। আসুন, আমরা উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য নিজেদের নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা ভেঙে সোচ্চার হই। আসুন, আমরা মানবতাকে বাঁচাই। না হলে কিন্তু সকল সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত সকল মানুষের হত্যার দায় আপনার আমার উপরেও পড়বে। আমাদের আত্মাতেও লেগে থাকবে নিরাপরাধ মানুষের রক্তের দাগ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.