জাকিয়া সুলতানা মুক্তা:
অনেকদিন পর হুমায়ুন আজাদ স্যারের লেখা পড়ছিলাম। ওনার ‘ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য’ বইটি পড়ছিলাম। ওখানকার একটা প্রবন্ধ আমার খুব পছন্দের, শিরোনামটা হলো ‘কয়েকটি কাক, চড়ুই ও সন্ধ্যাতারা’।
আজকে আবার পড়তে গিয়ে মনে পড়লো, কতদিন সন্ধ্যাতারা দেখি না। অথচ ছোটবেলায় না বুঝেও আমি প্রতিদিন আকাশের সন্ধ্যাতারাটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এমন কোনদিন ছিলো না, যেদিন আমি সন্ধ্যাতারা দেখতে বারান্দায় যেতাম না। ওই এক কারণেই আমি বারান্দায় যেতাম, আমার সেই কিশোর বয়সে। নাহ! কোনো প্রেমিকের টানে নয়, কেবলই এক নিরাবেগ সন্ধ্যাতারার অমোঘ টানে যেতাম। কবিতাও লিখেছিলাম ওই নাম না জানা সন্ধ্যাতারাকে নিয়ে, কোথায় আছে এখন সেই কবিতাখানি; আজ আর জানি না।
স্যারকে মেরে ফেললো প্রতিক্রিয়াশীলেরা, আমরা ওনাকে পাইনি। ওনাকে যেবার বইমেলায় কোপানো হলো, সে বছরই আমি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনও আমার ভর্তির কার্যক্রম শেষ হয়নি। স্যারের উপর বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো সারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি ভর্তির খোঁজ-খবর জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে এসেছিলাম সেদিন। একাই বসেছিলাম কলাভবনের সামনের রাস্তার ধারে। অবাক বিস্ময়ে দেখেছিলাম সেদিন ছাত্রলীগ, ছাত্রদল পরপর বিক্ষুব্ধ মিছিল নিয়ে আমার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছিলো। আমি তখন রাজনীতির বিশেষ কিছু জানি না বা বুঝি না। কেবল এটা জানতাম, এদের মাঝে একটা স্বাধীনতার পক্ষের দল আর আরেকটা স্বাধীনতার বিপক্ষের দলের সাথে আঁতাতকারী দল। কিন্তু উভয় দলের লোকেরাই কিনা বিক্ষুব্ধ একজন মানুষের উপর বীভৎস আক্রমণের জন্য, কীভাবে সম্ভব? এছাড়াও নাকি যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সে ইসলামবিদ্বেষী, ভয়ানক নাস্তিক! আমি আস্তিক-নাস্তিকের পার্থক্যও তখন খুব একটা বিস্তারিত জানতাম না, কারণ আমার আশেপাশে আস্তিক ব্যতীত তখন নাস্তিক কেউ ছিলো না। ‘এক কথায় প্রকাশ’ নামক ব্যাকরণিক পড়াশোনাতে, সেসবের একপেশে সংজ্ঞায়ন ব্যতীত তাই কিছু জানার সুযোগ সেভাবে হয়নি, বরং প্রবল আস্তিকতার জোয়ারে ভেসে যাওয়াতেই ছিলো আমার তখনকার বাস্তবতা।
আমি অবাক হলাম, বিস্ময়ে বিমূঢ় হলাম আরও বেশি; যখন কিনা সবে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলাম। দেখলাম, বাংলায় লেখা যৎসামান্য কিছু বই আছে ভাষাবিজ্ঞানের, বাকি সবই ইংরেজিতে। আমাদের ইংরেজি বইগুলোই বেশিরভাগ পড়তে হতো। আমার শিক্ষাগুরু সবার প্রতি আন্তরিক সম্মান রেখেই বলছি, আমি আনন্দ নিয়ে পড়তে পারতাম কেবল হুমায়ুন আজাদ স্যারের বইগুলোই। অন্যগুলো আমাকে তেমন টানতো না। তবুও আমি স্যারের কেবল সেসব বইই পড়েছি, যেগুলো আমার বিভাগের পড়াশোনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। অবিশ্বাস্য সত্য হলো এই যে, হুমায়ুন আজাদ স্যারের আর কোন বই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি পড়িনি এবং তা নিশ্চিতভাবেই কোন এক অর্থহীন ভীতি বা বাধার কারণেই। কিন্তু আমার বাবার একটা কথা আমার বরাবর মনে পড়তো সেসময়ে। আর তা হলো, একদিন আমি ভাষাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট স্যারের বইগুলো কিনতে গেলাম নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেটে। আব্বু আমাকে বললো~ “সবইতো দেখি হুমায়ুন আজাদের বই কিনছো। কেন?”
আমি বলেছিলাম, ‘ওনার বইগুলোই পড়া যায়, অন্যগুলো পড়তে ভালো লাগে না আমার।’
আমার তীব্রভাবে ধর্মবিশ্বাসী আস্তিক বাবাও তখন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, “জ্ঞানী লোক খুব। মতের মিল না হওয়ায় লোকটাকে কুপিয়ে মেরে ফেলতে চাইলো! এদেশে জ্ঞানের কোন কদর নেই!” আমি চট করে আব্বুর দিকে তাকালাম। কিছু বলিনি সেদিন। কেবল মূল্যায়নটা মনে রেখেছিলাম।
এরপর বহুদিন পর যেদিন স্যারের এই লেখাটা পড়েছিলাম, সেদিন আমারও মনে হয়েছিলো আমিও তো কতদিন কত মুহূর্ত এভাবেই প্রকৃতিকে দেখেছি, অনুভব করেছি। কিন্তু আমার আশেপাশের কেউ তো কখনো এভাবে প্রকৃতিকে অনুধাবন করতে বলেনি, অনুভব হয়তো করেওনি। কী অসাধারণ অনুভূতির প্রকাশ, কী শক্তিশালী!
“বাইরের জগতকে আমি আজকাল ভেতরে ঢুকিয়ে রাখি নিজের ক’রে, ওগুলোর সৌন্দর্য দেখি, যাতে কামের দেবতা নেই, অর্থের দেবতা নেই, সাফল্যের দানব নেই। আমার ভালোবাসা বাড়ির আঙ্গিনায় সবুজ কচুপাতায় টলমলে একফোঁটা শিশির, কাঁপছে; একদিন আর কাঁপবে না, সেই দিন আর কত দূর?”
উল্লেখ্য স্যারকে এভাবে মেরে ফেলে স্যারের তীব্র অনুভূতিকে মানুষের মাঝে আরও পোক্ত করেছে প্রতিক্রিয়াশীলেরা। এতটা বর্বরোচিত প্রতিক্রিয়াশীল না হলে, আমার মতন এই সাধারণ মেয়েটা কোনদিন হুমায়ুন আজাদ স্যারের লেখাকে অনুভব করতে পারতো না। এজন্য প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি কৃতজ্ঞতা, আর দীর্ঘশ্বাস স্যারের জন্য। আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য। আমরা তাঁকে হারিয়েছি, তাঁর মতন জ্ঞানী মানুষের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছি বলে। শ্রদ্ধায় ও সম্মানে স্মরণীয় যে ব্যক্তিত্ব, প্রিয় লেখক হুমায়ুন আজাদ; আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
আপনার প্রিয় কাকেরা, ভালোবাসার গর্ভবতী চড়ুই পাখিটা, আপনার আকাশপ্রদীপ আর সন্ধ্যাতারাকে আমিও ভালোবাসি; যেমন ভালোবাসি আপনার লেখাগুলোকে।