নাসরীন রহমান:
বাংলাদেশের সামাজিক সংস্কৃতির দিক থেকে ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ কথাটি এখনও বহুল প্রচলিত না।
ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ বলতে আমরা বুঝি স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে ধর্ষণ; সহজ কথায় স্ত্রীর অনিচ্ছায় তাঁর সাথে জোরপূর্বক শারীরিক সংসর্গে লিপ্ত হওয়াকে ম্যাটিরাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ বলে। অর্থাৎ যেখানে স্বামী তাঁর স্ত্রীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে জোরপূর্বক শারীরিক সংসর্গে আসতে বাধ্য করেন সেই পরিস্থিতিই ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ।
সাধারণত আমাদের সমাজে পরিচিত বা অপরিচিত কারো দ্বারা জোরপূর্বক নারীর সাথে শারীরিক সংসর্গে লিপ্ত হওয়াকে ধর্ষণ বুঝি কিন্তু স্বামীর দ্বারাও যে একজন নারী ধর্ষিত হতে পারেন এই বোধটুকুও আমাদের অনেকের মধ্যে নেই! স্বামীর দ্বারাও যে স্ত্রীকে ধর্ষণ সম্ভব এই ধারণাটি আমাদের সমাজে এখনো অপ্রচলিতই বলা যায়। স্বামীর হাতে ধর্ষণের ইস্যুটি এখনও অতটা গুরুত্ব
পাচ্ছে না সমাজে।
বরং ম্যারিটাল রেপ কে অনেকটা স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নেয় আমাদের সমাজ! বিয়ের পর স্ত্রী, স্বামীর ইচ্ছেমত তার ডাকে সাড়া দিবেন এটাই যেন অলিখিত বিধান! আমাদের সমাজ এটাকে দোষের কিছু ভাবে না বরং উল্টোদিকে এক্ষেত্রে স্ত্রী যদি রাজি না থাকেন তবেই বরং ব্যাপারটি হয়ে যায় দোষের!
কেন এই ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ?
ম্যারিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণের পেছনে কাজ করে মূলত পুরুষতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা বা পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব। আমাদের সমাজে অধিকাংশ পুরুষই মনে করেন বিয়ের পর স্ত্রীর উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাই স্বামী যখন যেমনভাবে চাইবেন স্ত্রী তাঁর ডাকে সাড়া দিবেন! এই ব্যাপারটিকে স্বামীরা তাঁদের বৈবাহিক অধিকার হিসেবেই ভাবেন তাই তারা স্ত্রীর উপর যথেচ্ছভাবে এই ‘অধিকার’ প্রয়োগ করেন।
তাদের এই ‘অধিকার’ বলেই তাঁরা তাই স্ত্রীর ইচ্ছে, অনিচ্ছার মুল্য দেনই না বললেই চলে। তারা যুক্তি দেখান ধর্ম তাদের সেই অধিকার দিয়েছে স্ত্রীকে যথেচ্ছভাবে ভোগ করার; ‘ভোগ’ শব্দটি এই কারণে লিখলাম এই বঙ্গদেশের পুরুষেরা আসলে [সকলে নয়] স্ত্রীর সাথে আনন্দময় শারীরিক সম্পর্ককে মিলিত
হয় না, তারা করে স্রেফ ‘ভোগ’।
কেন নারী এই ধর্ষণ মেনে নেয়?
প্রথমত বলতে হয়, অনেক নারী আসলে উপলব্ধিই করতে পারেননা যে তিনি স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছেন!
বৈবাহিক ধর্ষণ এবং আনন্দময় শারীরিক সম্পর্ক এর ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট ধারণা নেই বা উপলব্ধি নেই।
বরং উল্টোটাই ভাবেন তাঁরা ; অনেক নারীই ভাবেন স্বামীর মন যুগিয়ে চলা তাদের কর্তব্য। যেহেতু স্বামী তাঁর ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়েছেন, তার দেখভাল করছেন তাই স্বামী চাইলেই তাকে বিছানায় যেতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অনেক স্বনির্ভর নারীও এই মানসিকতা থেকে মুক্ত নন।
আরেকটি কারণ দেখা যায়, মেয়েদের বিশেষ করে গ্রামে বাসরঘরে ঢুকার আগে পই পই করে দাদী, নানিরা তাদের নাতনীদের এই মন্ত্র শেখান, ‘বর যা কইবো তাই শুইনো’, বিপরীতে বর তথা পুরুষকে শেখানো হয়, ‘বাসর রাইতে বিড়াল মাইরো’।
এই যে সামাজিক কিছু ব্যাপার যা আমরা সামাজিক সংস্কৃতির আওতায় ফেলতে পারি এসব কারণও দায়ী ম্যারিটাল রেপ এর পেছনে। উল্লেখিত কারণ ছাড়াও আরও বহু কারন কে চিহ্নিত করা যায় ম্যারিটাল রেপ এর পেছনে কিন্তু সবচাইতে বড়কথা এই অবস্থা থেকে উত্তরনের উপায়।
ম্যারিটাল রেপকে রেপ হিসেবেই চিহ্নিত করা এবং ম্যারিটাল রেপ থেকে মুক্তির উপায় কী?
আগেই উল্লেখ করেছি আমাদের সমাজে ম্যারিটাল রেপ কথাটি এখনো বহুল প্রচলিত না, বরং আপনি যদি ম্যারিটাল রেপ এর ব্যাপারে বলতে চান বরং আপনাকেই হেনস্থা করার লোকের অভাব হবে না। তাই যা করতে হবে তা হচ্ছে এই সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার। আশার কথা এখন অনেকেই ম্যারিটাল রেপ এত বিষয়ে মুখ খুলতে আরম্ভ করেছেন বা এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে।
সংখায় স্বল্প হলেও নারীর উপলব্ধিতে ম্যারিটাল রেপ বিষয়টি স্থান পাচ্ছে।
ম্যারিটাল রেপ এর ক্ষতিকর দিক কী?
ম্যারিটাল রেপ অপরিচিত মানুষের দ্বারা ধর্ষণের চাইতেও বেশি ক্ষতিকারক। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে একজন নারী অপরিচিত কারো দ্বারা ধর্ষিত হলে যে মানসিক ট্রমায় ভুগে তার চাইতেও বেশি মানসিক ট্রমায় ভুগেন স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলে। একজন ধর্ষক স্বামী তাঁর স্ত্রীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেই
যাচ্ছেন, আর ভুক্তভোগী নারী না পারছেন কাউকে বলতে, না পারছেন সহ্য করতে। মানসিক এই চাপে থাকতে থাকতে তিনি একসময় হতাশায় ভুগেন। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে তাঁর ভেতর জন্ম নেয় গভীর হতাশাবোধ যা তাঁকে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতার দিকে নিয়ে যায়।
মুক্তির উপায়?
কথায় বলে যার ব্যথা তার। সুতরাং নারীর ব্যথা নারীকের সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। আপনার স্বামী আপনার সাথে শারীরিক সংসর্গে যেতে চাইলেই প্রতিবার, প্রতিসময় আপনাকেও তাঁর ডাকে সাড়া দিতে হবে এমন কোন দিব্যি আপনাকে কেউ দেয় নাই। আপনি নারী আপনার ইচ্ছে, অনিচ্ছেকেও মূল্য দিতে
শিখেন। আপনারও ভালো লাগা মন্দ লাগা থাকতে পারে, অপকটে তা আপনার স্বামীকে জানান। নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছায় কথা যদি নাই বলতে পারলেন তবে তো আপনাকে আপনার স্বামীর ইচ্ছের বলি হতেই হবে। তাই দ্বিধা নয়, সংকোচ নয় স্পষ্টভাবে আপনার ইচ্ছে, অনিচ্ছের কথা জানান।আপনার সমস্যা আপনাকেই সমাধান করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, ম্যারিটাল রেপ নিয়ে আরও আলোচনা হউক। কারণ আলোচনা যত
হবে, নারীরাও তত সচেতন হবেন।