জেবুন্নেসার একজীবন

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী:

প্লেনের জানালা দিয়ে নিচে চোখ রাখতেই বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে জেবুন্নেসা খাতুনের। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সমানে দোয়া – কালাম পড়তে থাকেন আগের মতো। সিট বেল্টটাতে তার অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু তা বলা যাচ্ছে না। এয়ার হোস্টেস মেয়েটা এসে সিট বেল্ট বেঁধে দিয়েছিলো। দেশের মধ্যেই জীবনে প্লেনে চড়েননি জেবুন্নেসা। খুলনা থেকে ঢাকা আসতে হলে বাসেই যাওয়া- আসা করেছেন। এখন ঢাকা থেকে কানাডা উড়ে যেতে হচ্ছে বিশাল সাদা ডানাওয়ালা প্লেনে চড়ে৷ তুমুল শব্দে কানে তালা লেগে গেছে তার।

ইবু আর তানিয়ার বাড়িতে যাচ্ছেন তিনি ছেলে – ছেলের বউ নিয়ে যাচ্ছে তাকে। ছেলে- ছেলের বউ, মেয়ে – জামাই সবার সিদ্ধান্তে ভিটেমাটি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে হচ্ছে। মেয়ে – জামাই রুমু আর মিরাজের ওখানেও নিয়ে যাবে ওখান থেকে। কানাডার দুই শহরে দুই ছেলেমেয়ে জীবন গুছিয়েছে।
তাদের বাবা মানে জেবুন্নেসার স্বামী ইসহাক সাহেবের কবরের মাটি এখনো শুকোয়নি বলতে গেলে।

চল্লিশার পর্ব পার হতে না হতেই দেশ ছাড়ছেন জেবুন্নেসা খাতুন। আবার কবে ঘরে ফিরবেন, আদৌ ফিরবেন কিনা, নিজেও জানেন না। ফুলতলার একতলা বাড়ি, এক চিলতে উঠোনেই বাকী জীবন নিজের মতো কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি। “নিজের মতো” কথাটা সারাজীবনই যেন বাঁকা হাসি হাসে জেবুন্নেসার দিকে চেয়ে। ষাটোর্ধ বয়সে পৌঁছেও নিজের মতো বাঁচার সাধ তার পূর্ণ হবার নয়।
চল্লিশ বছরের দাম্পত্যজীবনে ইসহাক সাহেব কর্তৃত্বে, নিপীড়নে তার স্বামীই রয়ে গেছিলো, সঙ্গী হয়ে উঠতে পারেনি। শুধু স্বামী বলাও ভুল। নির্যাতক স্বামী।

বিয়ের আগে ঠিক যেভাবে বাবা কখনও ‘পরিবারের মাথা’র ভূমিকা থেকে বাবা হয়ে উঠতে পারেনি। পরিবারের একনায়কতন্ত্রের স্বৈরাচারী শাসক হিসেবেই বাবাকে দেখে এসেছেন। মায়ের মুখটা ছোট হয়ে থাকতো ভয়ে, অবহেলায়, অসম্মানে। তবু জেবুর জন্য গোপনে তার ছায়া বিলিয়ে যেতেন। পড়তে উৎসাহ দিতেন। ছোটবেলায় ডাক্তার হতে চাইতেন জেবু। পরে অনেক চেষ্টায় নার্সিং কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। তার মতামতের তোয়াক্কা না করে বাবার মতে বিয়ে হয়ে যায় দূর সম্পর্কের আত্মীয় ইসহাক সাহেবের সাথে।

মনিরামপুর উপজেলা থেকে ফুলতলায় শ্বশুরবাড়িতে চলে এলেন জেবু। সেবছরই মা চলে গেলো পৃথিবী ছেড়ে। মায়ের জন্য চোখের জল ফেলার সময়টুকু না দিয়েই বাবা শ্বশুরবাড়ি ফেরত পাঠালেন। মা চলে যাবার বছর খানেকের মধ্যে বাবাও মারা গেলেন। বেঁচে থাকলেও জেবুন্নেসার খোঁজখবর কেমন রাখতেন, সে আর বলে দিতে হয় না। মা চলে গেলে আদর করে “জেবু” বলে ডাকার আর কেউ রইলো না। বাবা তো আপদ বিদায় আগেভাগেই করেছিলেন। ভাইদের সংসারে জেবুন্নেসার কথা ভাবার জন্য কারই বা সময় থাকে!

ইসহাক সাহেব সাফ জানিয়ে দিয়েছিলো, অসুস্থ মাকে দেখাশোনার জন্যই বউ ঘরে আনা। সিন্ডারেলার সৎ মা যেমন রাজকীয় নাচের অনুষ্ঠানে যাবার পূর্বশর্ত হিসেবে সময় বেঁধে রাজ্যের কাজ জড়ো করেছিলো সিন্ডারেলার জন্য, ইসহাক সাহেবও তেমনি শর্ত জুড়ে দিলো, জেবুন্নেসা নার্সের ডিউটি করতে পারে যদি রান্নাবান্না, ঘরকন্নার কাজ, মায়ের সেবা আর ছেলেমেয়েদের দেখাশোনায় ব্যাঘাত না ঘটে।

নার্সিং পেশায় নিবেদিত হয়ে “নিজের মতো” বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলো জেবু। ইসহাক সাহেব আর তার সংসারে তখন এক পুত্র, এক কন্যা। শ্বাশুড়ি রোকেয়া বেগম বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী। তবুও কিছুদিন দশভুজার মতো শর্ত পূরণের প্রাণপণ চেষ্টা করে স্থানীয় একটা হাসপাতালে কাজ করে যাচ্ছিলো। ইসহাক সাহেব পৈত্রিক সম্পত্তি বেচাবিক্রি করে জুয়া খেলে বেড়াতো।

খেয়ালখুশি মতো উধাও হতো সংসার থেকে। দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতো না। মাস খানেক কাটিয়ে হঠাৎ একদিন জামিদারি হাবভাব নিয়ে বাড়ি ফিরতো, ভাবখানা এমন যেন বিশ্বজয় করে এসেছে।

ছেলে – মেয়ে তো দূরের কথা নিজের মায়ের সেবা পরের মেয়ের উপর চাপিয়ে স্বেচ্ছাচারী জীবন কাটিয়ে গেছে দিব্যি। মায়ের মৃত্যুশয্যার দোহাই দিয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করলো জেবুন্নেসাকে। জেবু হাসপাতালে গেলে ছেলেমেয়ের উপর নির্যাতন শুরু হলো। দুষ্টুমির অভিযোগে ভরদুপুরে মেয়েকে একদিন উঠোনে কান ধরিয়ে রেখে শাস্তি দিয়েছে। ছেলেকে মারধর করত যখনতখন। সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে জেবুন্নেসা হার মানলেন। “নিজের মতো” জীবন আর তার হলো না।

সংসারের ঘানি টানা আর ইসহাক সাহেবের সাথে এক বিছানায় ঘুমানো ছাড়া কোনো কাজ নেই তার।
ইসহাক সাহেব রাজার হালে নিজের স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যেতে লাগলো। জুয়ায় হেরে প্রায় সর্বস্ব খোয়ালো সে।
নিজের কিছু গয়না আর শ্বাশুড়ির নামে থাকা এক খন্ড জমি বিক্রি করে সে যাত্রা ফুলতলার ভিটেমাটি রক্ষা করা গেলো। রোকেয়া বেগমও চলে গেলেন একদিন। কঠিন দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেলেও
জেবুন্নেসার মনে হলো আরো খানিকটা একা হয়ে পড়লেন তিনি। রোগভোগে বিছানায় পড়ে থাকলেও এ সংসারে ছিলো তো কেউ! সেবা – যত্নতেও তো কখনো না কখনো ক্লান্তি এসে পড়ে। ইসহাক সাহেবের সাথে প্রেমহীন, অভিমানহীন, বরফ শীতল সম্পর্কের ক্লান্তি, সংসারে কেবল হার মেনে বেঁচে থাকার ক্লান্তি – সেসবের ছিটেফোঁটা জের যে জরাগ্রস্ত রোকেয়া বেগমের ওপর কখনো পড়েনি তা বলা যায় না। তবু শীর্ণকায় রোকেয়া বেগমের সাথে কী এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়েছিলো জেবু। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান তার পলকহীন দৃষ্টিতে কী নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পেতো জেবু?

জেবুন্নেসার মতো রোকেয়া বেগমেরও হয়তো এক সম্পর্কহীন সম্পর্ক ছিলো এ সংসারের সাথে! জেবুর আগে সংসারের নিরন্তর অবহেলায় রোকেয়া বেগমেরও ছিলো কড়কড়ে রোদ্দুরে উঠোনে ভেজা শাড়ি মেলে দিতে গিয়ে, ছাই দিয়ে এঁটো বাসন মাজতে গিয়ে অথবা স্নানের জলের সাথে রোজ ধুয়েমুছে যাওয়া কত নিভৃত চোখের জলের গল্প।

জেবুন্নেসার ছেলেমেয়েরা পড়ালেখায় ভালো। দুজনেই স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে চলে গেলো। জেবুর হাত – পা ঝাড়া না হতেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ইসহাক সাহেবের শরীরের বামপাশটা অবশ, অকেজো হয়ে পড়লো। মনের জোরও তার কোনোকালেও ছিলো না। আত্মবিশ্বাসহীন, অযোগ্য, ভীতু লোকেদের “মেয়েমানুষ” দমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সিংহের ন্যায় পৌরুষ জেগে ওঠে। ইসহাক সাহেব সেই কিছিমের সিংহপুরুষ বটে যে কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ইঁদুরসদৃশ তুচ্ছ জেবুন্নেসা ইহজীবনে তার কোনো কাজে আসতে পারে। নার্সের চাকরি নিয়ে কুকথা শোনানো ইসহাক সাহেবের সার্বক্ষণিক নার্সিং করতে জেবুন্নেসা ছাড়া কেউ রইলো না। দিনরাত মাথা নিচু করে বসে থাকতো ইসহাক সাহেব। তার জন্যে জেবুর নতুন করে কোনো মায়া কাজ করে না। তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিছক মানবতার খাতিরে প্রয়োজনীয় সেবার দায়িত্ব পালন করে গেছে জেবু। সেখানে কোনো আবেগ কাজ করেনি। ছেলেমেয়েরাও তাদের আর্থিক দায়িত্ব পালন করেছে। ইসহাক সাহেবের মৃত্যুতে জেবুর যতটুকু অশ্রুপাত সে নিজের সাথে অভিমানে, নিজের জন্যে। কেন সে আরেকটু শক্ত হতে পারলো না? জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো!

ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত সংসারের দরজায় জেবুন্নেসার শূন্যতা কড়া নাড়তে চায়নি। এবারও মনের গহীনে আবারো উঁকি দিয়েছে সেই গোপন – গভীর বাসনা – একটুখানি ‘নিজের মতো’ বাঁচা। স্থানীয় কোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবা দিতে চেয়েছিলেন।

ফুলতলার বাড়ির ছোট্ট উঠোনে লাউয়ের মাচা তুলে, হাঁস – মুরগি -কবুতর আর ফুলগাছের যত্নআত্তি করে, মাটির কলস থেকে একগ্লাস জল ঢেলে জীবনতৃষ্ণা মিটে যেতো দিব্যি।
কিন্তু ইসহাক সাহেব যখন মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন, ছেলেমেয়েরা ফোন করে তাগাদা দিচ্ছিলো তাদের কাছে মাকে নিয়ে যাবে বলে। রুমু তার ছোট বাচ্চা সামলে একা পেরে ওঠে না, মা গেলে তার কোনো চিন্তা থামে না। ওদিকে ছেলের বউ তানিয়া অকপটেই জানিয়েছে যে, শ্বাশুড়িকে নিজের কাছে নিয়ে তবেই বাচ্চা নেবার সিদ্ধান্ত নেবে।
উপর থেকে একঝলক নিচে তাকাতেই মলিন বাংলাদেশটা ছোট হতে দেখেছিলো ক্রমশ।
মেঘ কেটে কেটে বিশাল উড়োজাহাজটা কেমন হাল্কা হয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জেবুকে। এই মেঘে কী পা দুলিয়ে বসে আছে তার তার মা? জেবু, ও জেবু! কানে তালা লেগে থাকা অবস্থাতেও মায়ের মধুমাখা ডাকটা কতদিন পর স্পষ্ট শুনতে পেলেন তিনি! তন্দ্রাঘোরে চলে গিয়েছিলেন কখন যেন। রানওয়ে স্পর্শ করা প্লেনটা যেন পাখিদের দানব! যাত্রীরা সিট বেল্ট খুলতে শুরু করেছে।
জানালার বাইরে ঝা চকচকে নতুন শহরের হাতছানি। ‘নিজের মতো’ বাঁচার স্বপ্নটা আবারো অপূর্ণ রয়ে গেল। জেবুন্নেসার একজীবন বুঝি এভাবেই কেটে যাবে।

পরের গন্তব্য তার জানা নেই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.