দেবদ্যুতি রায়ের ‘নক্ষত্রবেলা’

সুরঞ্জনা মায়া:

নক্ষত্রবেলা। লেখক দেবদ্যুতি রায়ের তৃতীয় গল্পগুচ্ছ। বারোটি গল্প নয়, বারোটি নক্ষত্র দিয়ে যেন সাজানো বইটি। প্রতিটি গল্পেই মুন্সিয়ানার ছাপ। মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সমাজের সুখ, দুঃখ, সমস্যা লেখক খুব খুঁটিয়ে দেখেন তা এই বইয়ের গল্পগুলো পড়লেই বোঝা যায়।

একটি প্রেম কিংবা অপ্রেমের গল্প। সাধারণ গল্পই লেখকের গুনে অসাধারন হয়ে উঠেছে। নয়নতারা, মাহমুদের গল্পগুলো আমাদেরই গল্প হয়ে যায়।

উত্তরপুরুষ। অসুস্থ অক্ষম এক পুরুষের মনোবেদনা, কষ্ট, স্নেহ, ভালবাসা অপরূপ চিত্র।
কলকেফুলি মেয়ে। মিষ্টি একটি প্রেমের গল্প হতে পারতো। কিন্তু হতে পারেনি। ধর্মের বাধার দেয়ালের নাম অচ্ছুৎ।

যে জীবন অন্ধকারের। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অন্ধকার গলিতে জন্ম নেয়া এক কিশোর মনের টানাপোড়ন, মায়ের প্রতি ভালবাসা। পিতার ভালবাসার কাঙাল সোহেলের জন্য বুকের ভেতর টনটন করে উঠেছে।

অচেনা মুখ। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জঘন্য ব্যাধি ধর্ষণ নিয়ে এ গল্প। সমাজের নামীদামী তথাকথিত ভদ্র তকমাধারীরাও কি করে নিজের বিবেক বিসর্জন দেয় অবলীলায়। ধর্ষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সুযোগ মত নোংরা লোলুপ হাত বাড়িয়ে দেয় নারীর দিকে। তবে এখানে সেই লোলুপ হাত গুটিয়ে পালাতে দেখি কন্যাসম মেয়েটির হাতে ধারালো অস্ত্র দেখে। আশা জাগে মনে – আমাদের মেয়েরা নিজেদের রক্ষার জন্য সবাই যেন এমন করেই সচেষ্ট থাকে।

এইসব ছাইগন্ধি দিন। ধর্মান্ধ মানুষের ভিড়ে, অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের ভিড়ে আমরা যখন মাস্টারের মতো ভিন্নধর্মের ভস্ম হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে যাই। নিজের বিবেকের কাছে ছোট হতে হতে ছাইয়ের মতো ছড়িয়ে যাই তখন তখন সমাজে চোর, পকেটমার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আসাদুল বলে উঠে – “মামা, দ্যাশটাত আর মানুষ নাই বাহে!

বেসাতি। একজন সাহসী নারীর সংগ্রামের গল্প। ইশমত আরা, এসমো, নিষ্ঠুর বাবার হাতে মায়ের খুন হয়ে যাবার পর হয়ে যায় মৌসুমী। এই হয়ে যাবার পথ মোটেই মসৃন ছিলোনা। মায়ের স্মৃতি কাতর মৌসুমী দখল হয়ে যাওয়া ভিটে মাটি উদ্ধারে স্থানীয় শীর্ষ স্থানীয়দের সঙ্গে বেসাতি করে।

স্নেহ। এই সমাজে পুত্রের সংসারে পড়ে থাকা বৃদ্ধ পিতা, পুত্র, নাতনির গল্প। স্নেহের কাছে পরাজিত হয় জীবনের অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত। এ আমাদের খুবই পরিচিত দৃশ্য।

দেখা। গল্পটি এই বইয়ের অন্য সব গল্পের চেয়ে অন্য রকম। কিন্তু অবাস্তব নয়। জীবন যুদ্ধে হেরে অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হয়েও অগোচরে মনের গভীরে লালন করে ভালবাসা।

শারদীয়া। সমীর রঞ্জনের মতো বাস্তহারাদের মনোবেদনা, কষ্ট শত আনন্দের মাঝেও ঝেড়ে ফেলতে পারে না। এতো মমতা নিয়ে লেখক লেখাটি লেখেছেন যে পড়তে পড়তে পাঠক অশ্রুসিক্ত হবে।
কোথাও একটা ফুল থেকে যায়। স্নেহ, ভালবাসার অপর পিঠেই ঘৃণা বা বিরাগের বাস। এ কথাটি মনে পড়ে এই গল্প পড়তে পড়তে। রোজিনার মাতৃত্বের খবর শুনে মা হতে না পারা সাহেদার বুকের ভেতর রাগ, ক্ষোভ মুছে গিয়ে স্নেহ, ভালবাসা ফুল হয়ে ফোটে।

সুরঞ্জনা মায়া

এলিজি ১৯৭১। ফিরে যেতে হয় ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। বাবার ডায়েরিতে শরণার্থী শিবিরের কথা পড়ে প্রচেতা অনুভব করে সেই সময়টাকে। বাবাকে নিয়ে দেখাতে চায় সেই জায়গা। কিন্তু ৪৮ বছর পর বাবা ফিরে দেখতে চান না সেসব জায়গা। কারণ সেই সময়ে থাকা অনেক মানুষই এখন নেই। নেই শিবিরে থাকা প্রাণচঞ্চল সেই কিশোর কাঞ্চন। স্বাধীন দেশের সূর্যোদয় যে দেখে যেতে পারেনি।

সাবলীল, সুন্দর ভাবে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে গল্পগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করেছে। দেবদ্যুতি রায়ের লেখা আগের চেয়ে আরো অনেক বেশী শক্তিশালী মনে হয়েছে এই বইতে। বইটি পাঠককে সন্তুষ্ট করবে অবশ্যই। আপনারা বইটি পড়ুন। নিজে কিনুন, অন্যকে উপহার দিন।

লেখক-দেবদ্যুতি রায় (Devadyuti Roy)
বই-নক্ষত্রবেলা।
প্রকাশনী – পেন্সিল
বইমেলা স্টল নং ৩১৪
এছাড়াও রকমারি ডট কম এ বইটি পাওয়া যাবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.