চলে গেলেন ব্লগার, লেখক রাসেল পারভেজ। অকাল প্রয়াত রাসেল দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন, যা তার খুব কাছের মানুষজন ছাড়া খুব একটা কেউ জানতো না। মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে দেখলাম, নিয়মিত কিছু না কিছু লিখে গেছেন তিনি শরীরের এই অবস্থা নিয়েও। কোথাও জানতে দেননি ভিতরের ক্ষয়টুকুর কথা। উইমেন চ্যাপ্টারের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করছি।
শুদ্ধস্বর এর আহমেদুর রশীদ টুটুল তাঁর টাইমলাইনে রাসেল পারভেজের একটি গল্প দিয়েছেন, যেটি রাসেল তাকে দিয়েছিলেন ছাপানোর জন্য, আর টুটুলও রেখে দিয়েছিলেন পরে ছাপবেন বলে। সেই পরে আর সময় হলো না। লেখাটা নারীর লড়াই সংক্রান্ত বলে শুদ্ধস্বরের অনুমতি নিয়েই উইমেন চ্যাপ্টারে ছাপলাম, যদিও এখন আর এসব ছাপাটাপায় রাসেলের আর কিছু যায় আসে না।
সাদামাটা গল্প- (নিরবতার চুঁড়া- টাওয়ার অফ সাইলেন্স)
জরায়ুতে যুদ্ধের ক্ষত বয়ে যে মানুষটা সীমান্ত পাড়ি দিলো তার নিজস্ব ধর্ম নেই, সংস্কার নেই, রাষ্ট্র নেই, নাগরিকত্ব নেই। আধুনিক রাষ্ট্র যেভাবে নিজের নাগরিক নির্মাণ করে, বেয়োনেটে ছিন্ন জরায়ু সব নাগরিক পরিচয় বিচ্ছিন্ন করেছে শরীর থেকে- যুদ্ধ শুরুর আগে তার হয়তো নাম ছিলো- সীমান্তমুখী প্রতিটা পদক্ষেপে সে তার নাম বিস্মৃত হয়েছে।
যখন খাকি পোশাকের প্রহরী জিজ্ঞাসা করলো, “আপ কা শুভ নাম?” ফোঁটা ফোঁটা তাজা রক্ত ঝরছে, সেই রক্তের দিকে নিঃস্পন্দ তাকিয়ে থেকে সে বললো- “লাল, লালারুখ”। প্রহরী হাজিরা খাতায় লিখলো “১৫৭- লালারুখ বেগম”।
তার নিজস্ব কোনো পরিচয় ছিলো না, নিজস্ব সংস্কার ছিলো না, জরায়ুতে যুদ্ধের ক্ষত বয়ে, অসংখ্য সীমান্ত ডিঙিয়ে যুদ্ধে বিপন্ন মানুষদের উদ্ধার করা হয়তো তার নেশা ছিলো না। আমি জানি না। হয়তো এটাই ছিলো তার আত্মহত্যার নেশার মতো, আত্মপরিচয়হীন একজন মানুষ, যার জরায়ুতে যুদ্ধের ক্ষত- বুলেট-বোমা-মাইনকীর্ণ ভূমি ডিঙিয়ে, উদ্যত বেয়োনেট ঠেলে সরিয়ে বিপন্ন নারী কিংবা শিশুকে জড়িয়ে ফিরে আসছে ক্যাম্পে।
লাইফ ম্যাগাজিন, টাইমসের মতো পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে, ফিয়ারসাম ফাইটার, ট্রু ফিনিক্স- আমি জানি না সে কী ভাবতো? কীভাবে ভাবতো? আমি তার সাথে ছিলাম বেলুচিস্তানে, ওয়াজিরিস্তানে, করাচির ক্যাম্পে কিংবা বসনিয়ায়। কখনও সে শিয়া, কখনও সে সুন্নি, কখনও সে খ্রিস্টান, কখনও সে ইয়াজিদি নারী। তার নিজস্ব কোনো সংস্কার নেই, নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই, তার ধর্ম নেই, জাতীয়তা নেই।
তার প্রশান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছি, জীবনানন্দের কবিতার মতো গভীর প্রশান্তির ঘুমের মায়া লেগে আছে তার মুখে, তার ঠোঁটের কোণে অবশেষে ঘুমানোর তৃপ্তি- “বেগম লালারুখ, লাল বিবি” তোমাকে কী পরিচয়ে সমাহিত করা হবে এখনও আমরা জানি না? উপস্থিত মানুষেরা দ্বিধা-বিভক্ত। সমাহিত করা হবে না কি দাহ করা হবে, এখনও ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি কেউ। মেয়েটার বয়স আর কত হবে, সদ্য ১৩ পেরুলো, ইয়াজিদি, ভাঙা গলায় যা বললো- তার অর্থ দাঁড়ায় আমার দিদি, আমার মতো যুদ্ধাহত জরায়ু নিয়ে পৃথিবীর বুকে ঘুরছে, তার ভেতরের আগুনটা আমরা দেখিনি কেউই? এখন তার জীবনাবসানে আমরা নিজেদের সংস্কার নিয়ে তাকে বিদায় দেওয়ার আয়োজন করছি। সে তার আত্মপরিচয় নিয়ে চুপ ছিলো তার সমস্ত জীবন। এই নিরবতাই হয়তো তার প্রতিবাদ।এই যে প্রচলিত সব সংস্কার, নাগরিকত্বের ফাঁদ স্বেচ্ছায় উপেক্ষা করে যাওয়া, এটাই তার মহত্ত্ব। তাকে আমরা কি সমাহিত করবো, সে তো আমাদের সকল রীতি-নীতিকে কবর দিয়ে যুদ্ধহত জরায়ু নিয়ে এক জীবন কাটিয়ে দিলো অবলীলায়। তাকে দূরের নিরবতার চূঁড়ায় রেখে আসো। সেখানে নির্জনে প্রকৃতির সাথে মিশে যাবে সে আলগোছে। হয়তো এমনটাই সে চেয়েছিলো, উদযাপনহীন সাদামাটা প্রস্থান।
আমরা কেউই তার স্বজন ছিলাম না। সে আমাদের সহযাত্রী ছিলো গত ৪৮ বছর, আমরা তার নাম জানতাম না, সাদা একটা কাপড়ে মোটা আলকাতরার তুলিতে লেখা ছিলো “১৫৭ঃ লালারুখ বেগম”।