অনসূয়া যূথিকা:
এই দুনিয়ায় কতো রকম কথার যে চল আছে আর কতো কিছু যে মানতে হবে মাইয়াগোরে, ভাবতেসি!
লাইফে কুনদিন পাতিলের তলার পোড়া ভাত খাই নাই, তবু আমার বিয়ার দিন আকাশ যেনো ভাইঙ্গা পইড়া যাইবো এমন হাল হইসিলো৷ ঘটনা হইলো শাওন মাসে বৃষ্টি অবধারিত, কিন্তু বিয়াটা লাগবি তো লাগ বৃষ্টির দিনেই লাগাইতে হইলো৷ এমন বৃষ্টি যে আমার নাম বদলায়া বাদলা কইন্যা হইবার মতো হাল। বৃষ্টির কারণে আটকা পইড়া নাকি খাওন মজা দেইখা জানি না একেকজনে নাকি ডবল কইরা খানা খাইসিলো৷
আমার এক কাজিন ভাই কইসেন, তিনার পুরা গ্রুপ তিনবার নাকি খাইসেন৷ পরে আবার রানতে হইসিলো, কিন্তু এইসবে আমার শ্বশুরের পরিবার মাইন্ড খান নাই৷ চেয়ার টেবিলও ভাঙেন নাই৷ কিন্তু একা আমার না, ভাইবা দেখলাম আমাগো জাতের বেবাক মাইয়ার বিয়া জুন-জুলাই মাসে।
কিন্তু ফালগুন বা বৈশাখেও বিয়ার অভাব নাই। এমনকি দুর্জনের মুখে ছাই দিয়া বাঙালি এখন পারে তো কার্তিকেও বিয়া কইরা বউ তুলতে চায়। তো আমার এক ছোট ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো তাই গ্রামে গিয়েছিলাম। এখনও বহু পরিবারে চল আছে গেরামের বাড়িতে সকল আত্মীয় কুটুমরে নিয়া বিয়ার অনুষ্ঠান করার। বিয়া, গায়ে হলুদ, বৌভাত, বিয়াইভাত, তারপরে আবার অষ্টমঙ্গলা যারে কয় ফিরানি বা ফিরাযাত্রা মোটামুটি বিয়ার সব অনুষ্ঠানাদি ধর্ম ভেদ থাকলেও মিল আছে। আছে বহু আচারগত মিলও।
ভাইয়ের গায়ে হলুদের দিন ছিল, সকালে আমরা সব মেয়েরা তারে স্নান করাবো বলে জমায়েত হয়েছিলাম বাড়ির উঠানে৷ কীসব যে প্রথা চলে একেকটা অঞ্চলে৷ সাত সাতটা পুকুর থেকে সেই কোন কাকভোরে সাত কলসি জল আনা হলো আমপাতা রেখে৷ করবে স্নান, সেটাও আবার আভাঙা জল হতে হবে নাকি। মানে হলো সেই কাকভোরেরও আগে, জনমানুষ জাগার আগে গিয়ে জল নিতে হবে পুকুর থেকে।
কাঁচা হলুদের সাথে মেথিসহ হলুদ কোটা হলো৷ এইজন্য বলে সোঁথা মেথির গন্ধ মাখা গায়ে হলুদ। এই হলুদ আবার যাবে কনের বাড়ি, সঙ্গে কারা কারা যাবে সেই নিয়ে যখন উৎকন্ঠা চলছে এর মধ্যেই বৃষ্টি নামলো, সাজগোজ করে তৈরি হওয়া সব কজন নারী আগেই ভিজে সারা৷ আষাঢ় মাসে এমন বৃষ্টি স্বাভাবিক, কিন্তু ভাই খুব মজা করতে লাগলো।
সমস্যা বাঁধলো একটু পরই, আরেকটা বিষয় নিয়ে। আমাদের এক বোনের মাসিক চলছে এবং তিনি তাই হলুদ ছোঁবেন না৷ এরপরে জানলাম আরেক ভাইয়ের বউ, সেও হলুদ ছোঁবে না তারও মাসিক শেষে স্নান করা হয় নাই।
এখনও বহু বহু বাড়িতেই চল আছে, কারো মাসিক শুরু হলে সেটা পরিবারের কর্ত্রীকে জানাতে হবে! সে সম্পর্কে কন্যা হোক বা পুত্রবধূ। ভীষণ ভীষণ রকম অবাক লাগে যখন দেখি, কারো মাসিক হলে তারে পরিবারের কোন শুভ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেয়া হয় না৷ আমাদের সমাজে যে কত রকমের অদ্ভুত নিয়ম মানা হয়!
সেই ভাইয়ের বউ হলুদ, বিয়ে, বৌভাত কোনটাতেই গেলেন না, বা বলা ভালো যেতে দেয়া হলো না। তার শাশুড়ি, জায়েরা বলতে লাগলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে কারো গায়ে যেনো তার ছোঁয়া না লাগে৷ একজন মুরুব্বি তো বলে বসলেন, মাসিক চলাকালে সে কেন নিজের ঘর ছেড়ে বিয়ে বাড়িতে এলো! সেকি জানে না এরকম সময়ে অপদেবতারা ভর করে নারী শরীরে! বাপের বাড়ি থেকে তাকে কি শেখানো হয় নাই এসব আদব কায়দা, রীতিনীতি?
এমনকি নতুন বৌ বরণ করতেও তিনি থাকলেন না৷ বৌয়ের গায়ে যেন তার ছোঁয়া না লাগে তাই বলা চলে একরকম বন্দী হয়ে থাকলেন৷ মাসিক চলছে এটা শুরুতেই বাড়ির বড়দের না জানানোর অপরাধ গুরুতর। তাকে তাই বিয়ে বাড়ি থেকে আলাদা একটা বাড়িতে সরিয়ে দেয়া হলো। তার হাতে যা যা দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তা করা হলো বাতিল৷ তার আনা নতুন বউয়ের জন্য নানান রকম জিনিসপত্র শুদ্ধ করে নেয়া হলো।
বিয়ের কনের জন্য যেসব জিনিসপত্র পাঠানো হচ্ছে সেসবও তিনি আর ছুলেন না, দেখলেনও না।
তাকে এরকম আলাদা করে রাখাটা বড় বেশি রকম দৃষ্টিকটু লাগছিল। বহু তর্ক বহু রকমের বোঝানোর চেস্টা করে এই মানুষগুলোর কাছে কেবলমাত্র বেয়াদব নামই পেলাম৷ এদের একটাই কথা ধর্ম বলে মাসিক মানে অপবিত্র। কোন রকম ধর্মীয় প্রার্থনা তখন করা যাবে না, এমনকি ঢোকা যাবে না রান্নাঘরে। মাসিকের সময়ে রান্না করলে সেই নারী পরজন্ম হবে কুকুর আর যে স্বামী ঋতুমতী স্ত্রীর হাতে রান্না খাবেন সেই পুরুষ পরজন্মে হবেন ষাঁড়। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে স্মার্ত রঘুনন্দন শাস্ত্রী মহাশয়ের বা মনুসংহিতা মেনে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের সমস্ত রকম আচার আচরণ চলে।
গোঁড়া সনাতন ধর্মের মানুষেরা আবহমানকাল থেকেই এসব নিয়ম মেনে আসছেন। সাম্প্রতিক বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার তাঁর প্যাডম্যান ছবিতে দেখিয়েছেন কিভাবে ঋতুমতী নারী পরিবারের এককোণে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে তার মাসিকের সময় গুলোতে। সাত সাতটা দিনের বন্দীদশা, চূড়ান্ত অপমান নারীত্বের। সারা পরিবার, পাড়া মহল্লার মানুষ জানান দিতে হবে কোন বাড়িতে কার মাসিক চলছে!
সময় অনেক এগিয়েছে, মানুষ অনেক আধুনিক হয়েছে কিন্তু সংস্কারের নামে এইসব কুপ্রথার হাত থেকে নারীর মুক্তি নাই। এখনো শুদ্ধতার নাম করে চলছে আমাদের নানান ধর্ম গুরুর এইসব মত প্রকাশ বা ফতোয়া জারি। ভারতের এক ধর্ম গুরু যেমন নিদান দিলেন৷, মহিলা কলেজের মেয়েদের অন্তর্বাস খুলে পরীক্ষা করতে তারা ঋতুমতী কীনা। কেননা মাসিক চলাকালে তাদের জন্য আলাদা থাকবার ব্যবস্হা করা আছে। কেবলমাত্র পরিবার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও চলছে এইসব বাতিল যুগের রদ্দি প্রথা। মাসিক চলছে মানেই একজন নারী অপবিত্র, অচ্ছুৎ।
মানুষ যতো শিক্ষিত হোক এইসব কুপ্রথা থেকে পুরোপুরিভাবে যেনো নিস্তার নাই কারো৷ তাই বিশ্বজুড়ে ইসকন ধর্মাবলম্বী নারীরা যখন তাদের ঋতুস্নানের সময়ে পুজা দেন, রান্না করেন তখন অপরাপর মানুষ তাদের নিন্দা করেন। ইসকনের বহু সমালোচনা হতে পারে বটে কিন্তু এই কুপ্রথা ভাঙার বিষয়ে তাদের জন্য শ্রদ্ধা চলে আসে। ঈশ্বরকে সন্তানতুল্য মনে করে নারী তার সন্তানের জন্য রাঁধেন তার ঋতুস্নানের সময়ে। সন্তান অভুক্ত থাকলে কোন মা স্থির থাকেন না এই বিশ্বাস থেকে। জানা কথা গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের তাতে ঘোরতর আপত্তি থাকার কথা, কিন্তু ইসকন ধর্মাবলম্বী মানুষদের মাঝে নারীর প্রতি এই উদারতা ভালো লাগে। সারা বিশ্ব যখন নারীর জন্য বৈরী, তারা তখন মহাপ্রভুর মহাপ্রসাদ থেকে ঋতুমতী নারীকে ব্রাত্য ঘোষণা করে নাই। তাই বলে আমাকে ইসকন সমর্থক ভাববার কোন কারণ নাই। এই একটা বিষয় ছাড় দিলেও আমি তাদের কট্টর সমালোচক, বিরোধী পক্ষও বটে।
আমার সবচেয়ে অবাক লাগে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আচরণ দেখে। তাদের ধর্মে স্পষ্ট করে বিধান দেয়া আছে মাসিক বা হায়েজ চলাকালে তারা কি কি করতে পারবেনা। নামাজ বা রোযা তারা করতে পারবে না বটে, কিন্তু দোয়া পড়তে তো বাধা নাই। সন্তান জন্মের পরে যে রক্তপাত যাকে তারা নেফাস বলেন, সেই সময়ের জন্য আলাদা করে সমস্ত মাসলা মাসায়েল আছে। তবু জানি না কেন তারাও এইসব নিয়মে নিজেদের আটকান যে কোনো শুভানুষ্ঠানে তারা যেতে পারবেন না। কেন মাসিক চলাকালে তারা কোন বিয়ে বা গায়ে হলুদের নিমন্ত্রণে যেতে পারেন না। কেন অযুহাত দিয়ে বলেন, মাসিকের নারীর গায়ের বাতাস ভালো না।
তাদেরও বলতে হয়, মাসিক নিয়ে বাইরে যেতে নাই, গায়ে সাবান দিতে নাই, চুল খোলা রাখতে নাই, সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহার করা ভালো না। আজও বহু পরিবারে কোন ঋতুমতী মেয়ে স্কুলে না গিয়ে ঘরে বসে থাকে। বুঝলাম তারা নামাজ পড়বে না, বা রোযা রাখবে না, কিন্তু কোন রকম ভালো কাজে তারা ব্রাত্য, এইটা ধর্মের কোথায় আছে?