নাসরীন রহমান:
অতিসম্প্রতি প্রথা ভেঙে দৌলতদিয়ার একজন যৌনকর্মীর জানাজা পড়িয়ে আলোচনার এসেছিলেন যে ইমাম তিনি বলছেন, তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো কোনো যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না। হামিদা বেগমের জানাজা পড়ানোর পর তিনি স্থানীয়ভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছেন তাই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন!
ধারণা করা যায় সমাজে যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে এই জানাজার আয়োজন করা হয়েছিল; কিন্তু জানাজা পরবর্তী যে প্রতিক্রিয়া তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়, পল্লীর বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর উল্টো মনোভাবই বিরাজমান!
ইমাম সাহেবের ভাষ্যে,'”এইখানে তো সমালোচনা হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার সমালোচনা করছে। এতোদিন জানাজা হয় নাই, আমি কেন হঠাৎ করে জানাজা পড়াইলাম?”
দেখা যাচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষই এর বিরোধিতা করছে! তাদের মতে জানাজায় নেয়া যাবে কিনা তারা ঠিক করবেন, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যৌনকর্মীদের প্রতি তাদের নেতিবাচক মনোভাব।
পেশা হিসেবে যৌনকর্ম ভালো কী মন্দ? গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য? স্বীকৃতিযোগ্য অথবা পরিত্যাজ্য? তার চাইতে বড় কথা সাধারনের এই যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যৌনকর্মীদের প্রতি এটা স্ববিরোধীতা নয় কি?!
আপনারা চুপিচুপি যৌন-পল্লীতে যাবেন আবার যৌনকর্মীদেরই বলবেন অচ্ছুৎ,
খারাপ, ছি ছি …। তা কী করে হয়? কেন ওই স্থানে যাবার সময় কি মনে থাকে না, এরা,’খারাপ’?
এদের জানাজা পড়ালে আপনাদের এত মাথাব্যথা! আর এদের কাছ থেকে যখন শারীরিক সুখটুকু নেন তখন আপনাদের ধর্ম, বিবেকবোধ
থাকে কোথায়?
আপনাদের দৃষ্টিতে যৌনকর্মী যদি পাপী হয় তবে জেনে রাখেন, মহাপাপী হচ্ছেন
আপনারা, যারা যৌন-পল্লীতে যাতায়াত করেন। যারা ঘরে বউ রেখে আপনাদের বহুগামি মনকে মনোরঞ্জন দিতে যান যৌন-পল্লীতে। আসল চরিত্রহীন আপনারা পুরুষ, আপনাদের মন, শরীর দুটোই
অপবিত্র, কুৎসিত, কালো।
আপনারা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করেন আর এই সমাজের সভ্য মানুষগুলোই তো যান আপনাদের ভাষায় ‘অসভ্য’ যৌনকর্মীদের কাছে। অথচ দিনের আলোয় নিজের রাতের কালো চেহারাটাকে লুকিয়ে ‘ভালো মানুষ’ এর মুখোশ পরে আবার ঘৃণা করেন ওই যৌনকর্মীদেরই!
ধিক পুরুষ!
ধিক বহুগামি পুরুষ আপনাদের!
যৌনকর্মী যদি আপনাদের দৃষ্টিতে পাপী হয়; তারা এ কাজ করে পেটের দায়ে, ক্ষিদার চাহিদা মেটানোর জন্য। স্বেচ্ছায় যৌনবৃত্তি বেছে নিয়েছে এমন দেখেছেন ‘মূর্খ পুরুষ’? থাকলেই তা কয়জন?
আর আপনি আসেন আপনার মনোরঞ্জন করার জন্যে। তাহলে আসল পাপী কে? নিজেকে
প্রশ্ন করুন পুরুষ, উত্তর পেয়ে যাবেন।
যে পেশায় এতো কষ্ট, অপমান, যে পেশায় সমাজের ভোগ্য হয়েও সেই সমাজেরই নাকসিঁটকানো দেখতে হয়, সেই পেশায় কি শখের বশে বা বিলাসিতা করে আসে নারী; দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই আসে। এরকম একেকজনের ওপর ভর করে চলে পুরো সংসার। যে সমাজ মেয়েদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান দিতে পারে না, সেখানে তাদেরকে ‘নষ্ট’ বলে গালি দেয়ার আগে নিজের ঘরের দিকে তাকান।
আপনি পুরুষ, যৌন-পল্লীতে যাতায়াত করেও যদি মৃত্যুর পর জানাজা পেতে পারেন, তবে ওই যৌনকর্মীও জানাজার দাবি রাখে। যৌনকর্মীর লাশটা যদি জানাজা না পায়, তবে ‘পাপী বহুগামি পুরুষ’ আপনার লাশও জানাজার দাবি রাখে না। পাপের শাস্তি দিবেন মহান আল্লাহ তায়ালা, আপনি আমি না।
তাই পরিশেষে একটি কথা বলেই শেষ করতে চাই, এই লেখা, যৌনকর্মীর দিকে আঙুল তোলার আগে আয়নায় নিজের চেহারা একবার দেখুন পুরুষ; হলফ করে বলছি আপনারা নিজেরাই আঁৎকে উঠবেন অনেকে নিজেদের আসল চেহারা দেখে; কারণ অধিকাংশ পুরুষের ভেতরেই বাস করে এক একজন ‘পতিত’ মানবসত্তা।