আসমা অধরার ‘ওয়ালথার পিপিকে’

আফসানা কিশোয়ার লোচন:

ওয়ালথার পিপিকে, এ তো পিস্তলের নাম; যদ্দূর মনে পড়ে মাসুদ রানার প্রিয় অস্ত্র। আমাদের কবি আসমা অধরা এর কাব্যগ্রন্থের নাম “ওয়ালথার পিপিকে”। কবিতার আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে বোধ বেদনা ও স্যাটায়ার এর গুলি ছুঁড়ে যিনি নিজের সৃষ্টির সাক্ষর রেখেছেন বিবিধ অক্ষরমাত্রায়।

আসমাকে যারা ব্যক্তিজীবনে চেনে তারা জানে তিনি কতটা আমোদপ্রিয় মানুষ। অথচ তার কবিতা গভীর বিষণ্নতার এক এলিজি। কবি মাত্রই হয়তো এই ধূসর সময়ে এমন-নিঃসঙ্গ, অক্ষরই যাপিত জীবনের ক্ষোভ বিক্ষোভ আশাবাদ ব্যক্তের একমাত্র উপায়। ‘ভিন্নচোখ’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, ৫৬টি কবিতা নিয়ে গড়ে উঠা বইটির মূল্য ১৫০ টাকা। বইটি কবি উৎসর্গ করেছেন “আমার অতিব্যক্তিগত ‘তুমি’কে”।

আসর ফুল ঢলে যায় মাগরিব!
উড্ডীন পাখি পর ঝরিয়ে ওড়ে;
ওড়ে এক আকাশেই,মুখর পড়ন্ত রোদ
বুনে দিচ্ছে আলপনা সে নামে!
আহা গুল! ফোটো সন্ধ্যায়,তোমায়
মালতী বলে ডাকি,বিরহী বুকে
মাগরিব মানেই ডেকে ওঠা আন্ধার…

মনে হলো না একটা পাখি ওড়া,ফুল ফোটা আযানের সুর ঘেঁষা প্রশান্তির সন্ধ্যা এই বুঝি নেমে আসছে?না শেষ লাইনে এসে সেই প্রশান্তি কিন্তু তিরোহিত হয়ে গেল এক লহমায়,এ সময় মানুষ আর ও একা হয়ে যাচ্ছে,বুকের ভেতর জমে যাচ্ছে অন্ধকার। কোন আলপনা সেই একাকীত্ব কে আর রাঙাতে পারছে না।

রাত নিশ্চিত হলো কেবল
দেখো হা-পিত্যেশ, কত খুন
নিরস্ত্র জীবনের পাশে শুয়ে থাকে
শীতল ধাতু

মানুষ মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর প্রবেশ করে তার মননের খুন করে ফেলছে,মগজে আর উদারতা নেই, সেখানে রক্তহীন লড়াই,আদতে হয়তো এই লড়াইতে অস্ত্র চাক্ষুষ করা যাচ্ছে না,অথচ হারপুনে খুন হয়ে যাচ্ছে…

এক এক সময় নীরবতা ও তৃষ্ণার এক প্রতিভূ হয়ে ওঠে-কবি বলে ফেলেন বাক্য হিম হয়ে গেলে,জমে যায় খুব নৈঃশব্দ্য।

এরকম চমকপ্রদ অক্ষরবিন্যাসে অধরা আমাদের ধরে রাখেন কবিতার বই এ। আমি পাঠক বারবার পড়ি এক এক কবিতা, এ যেন বাংলার পরাবাস্তব বক্তব্য খুব সংক্ষেপে। পোস্ট মডার্ন গদ্য পদ্য কোনটাই সহজিয়া আলাপ পছন্দ করে না,অক্ষরের তুলিতে আধেক বোল দিয়ে পাঠককে বাকীটা বুঝে নিতে বলে-

সমস্ত ব্রাঞ্চ বন্ধ করে দিয়ে
এক শাখায় জড়ো হয়ে আছে বেঁচে থাকা
অভিধান ভরে থাকা এতো সমার্থক
মৃত্যু নাম পাতায়,শুধু শূন্যতা আঁকা।

এ কি ব্যাখ্যা করে দিলে রস আস্বাদন করা যাবে? না কি নিজের মনে পাঠক কে তার গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে ভুলের মাঝে বেঁচে থাকাকে সামনে এনে বুঝে নিতে হবে?

দুহাত স্তব্ধ করে বসে থাকা সন্ধ্যেয়
বিষণ্ণ মৃত্যুর সঙ্গে মোলাকাত হলে,
চোখ তুলে দেখে ফের মন দিই
পাতা কুড়োনোতে, পাতা কী বয়স?

পাতা ঝরার মতো বয়স বেড়ে যাচ্ছে? সাথে মৃত্যু এগিয়ে আসছে একটি দুটি তিনটি পাখির ডানায় ভর করে?

ক্ষয়িষ্ণু মনের ভেতর তুলির মতন লাল ছড়িয়ে
কোন একদিন খুব ভোরে এলোমেলো
এমন সব বসন্ত বাতাসের মতন
আমার কপালে একটা গোটা সূর্য ছুঁইয়ে দিও…

মানুষ আশায় বাঁচে,ভালোবাসার অভীপ্সা তার রক্তে রক্তে,কবিও একদিন তেমন প্রণয়পূর্ণ একটি আলোকিত দিনের ছবি আঁকেন এইভাবে।

সবচাইতে করুণ আকুতির কবিতা সম্ভবত ‘মা’-

প্রতিরাতে বিলুপ্ত রোমান সভ্যতার ভাঁজে ভাঁজে
হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্য বাতাসের মতন
দুমড়ে মুচড়ে হু হু করে কেঁদে যাবার নাম মা!
মা কাঁদলে ভিজে যায়
কপোল,চিবুক,বুকের সীমানা,পুরোটা আঁচল;
তবু কখনো শব্দ হয় না!

আফসানা কিশোয়ার লোচন

মাতৃহারা সন্তানের এ হাহাকার ইথারে ইথারে ভেসে বেড়াবে সৃষ্টির লয় পর্যন্ত।

সংবেদ কবিতাটা অধরা লিখতে পেরেছেন শুধু নারী বলেই,এখানে আমি তাকে নারী কবি বলব ক্ষমা চেয়ে নিয়ে,এমন শ্লেষ জীবনাভিজ্ঞতা ছাড়া একেবারে সম্ভব নয়-

স্তন-এক প্রচণ্ড সেন্টিমেন্টাল শব্দ
যুদ্ধ,বিগ্রহ,পূজো,অর্চনা,আর
মোল্লা থেকে পুরুত,পাদ্রী থেকে শিশুর মুখে
সর্বতোভাবে এঁটে যায়। যেন চাঁদমামা।

অনেকেই বলেন কবিতা লেখা হয় না, নারীরা তো আর ও কবিতা লিখতে পারে না। কবিতার পাঠক নেই, কবিতার বই বিক্রি হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি।

যারা কবিতা পছন্দ করেন তারা আসমা অধরার “ওয়ালথার পিপিকে” বইটি সংগ্রহ করুন ও ডুবে যান পরাবাস্তব অক্ষর বিন্যাসের গ্রহে।

শেয়ার করুন: