ওই ধর্মগুরু তো পুরুষদের রান্না শিখতেও বলেছেন!

সুপ্রীতি ধর:

নারীরা পিরিয়ড চলাকালীন রান্না করলে পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মাবেন, আর যেসব পুরুষ ঋতুমতী নারীদের রান্না খাবেন তারা ষাঁড় হয়ে জন্মাবেন আবার! এমনটাই বলেছেন একজন অতিশয় হিন্দুত্ববাদী ধর্মগুরু। তার বরাত দিয়ে ভারতের একটি পত্রিকায় একথা বলা হয়েছে। খুবই ভালো কথা, অতিশয় আনন্দের কথা। কুকুর এবং ষাঁড় মানে গরু, দুটোই প্রিয় প্রাণীর তালিকায়, তাই এটুকু সান্ত্বনা আমরা নিতেই পারি। নারী হয়ে এই জন্মেই বা কী এমন স্বর্গপ্রাপ্তি আমাদের ঘটেছে, তা আমার জানা নেই।

তো, সেই হিন্দুত্ববাদী গুরু কী বলেছেন? ‘ঋতুকালীন অবস্থায় যে সব নারী স্বামীর জন্য রান্না করেন, তাঁরা পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মাবেন!’

এখানেই শেষ নয়। গুজরাটের ভুজের স্বামীনারায়ণ মন্দিরের স্বামীনারায়ণ গোষ্ঠীর ‘নর-নারায়ণ দেবগড়ী’ স্বামী কৃষ্ণরূপ দাসজী আরও নিদান দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ‘ধর্মগ্রন্থেই রয়েছে, ঋতুচক্রের সময়ে স্ত্রীর রান্না খাবেন যে স্বামী, তিনি পরজন্মে ষাঁড় হবেন।’’

এই মন্তব্যের জন্য স্বামী কৃষ্ণরূপ দাসজীকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন স্তরে। কিন্তু আমার কেন জানি সমালোচনা দূরে থাক, ভীষণ হাসি পাচ্ছে শুনে। কুকুর আর ষাঁড়ের কম্বিনেশনটা কেমন হবে ভেবেই! আবার পুরো খবরটা পড়ে অনেক তথ্যও পেলাম যা কিনা আমাদের অধিকার আন্দোলনে সহায়কই হয়। ভেবে দেখুন।

আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, এই ধর্মগুরু যে মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত, তারা ভুজে একটি কলেজ চালায়। কিছুদিন আগে সেই কলেজেরই অধ্যক্ষ এবং নারী কর্মীরা ৬০ জন মেয়েকে জোর করে অন্তর্বাস খুলতে বাধ্য করেছিলেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেন, ওই মেয়েদের তখন ঋতুস্রাব চলছে কিনা! কারণ ওই কলেজের হোস্টেলের ‘নিয়ম’ রয়েছে, ঋতুস্রাব চললে সেই মেয়েরা সবার সঙ্গে বসে খেতে পারবে না! ১১ ফেব্রুয়ারির এই খবরটি ভাইরাল হওয়ার পর ওই কলেজ অর্থাৎ শ্রী সহজানন্দ গার্লস ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ, রেক্টর এবং পিওনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এর পরেই প্রকাশ্যে এসেছে স্বামী কৃষ্ণরূপ দাসজীর এই নতুন নিদান। এক ভিডিওতে গুজরাটি ভাষায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে ওই সব মন্তব্য। সেটি ভাইরালও হয়েছে। ওই গুরু আবার দাবি করেছেন, ‘আমার মতামত আপনাদের পছন্দ না হলে আমার কিছু এসে যায় না। এসব আমাদের শাস্ত্রেই লেখা রয়েছে।’ কথা সত্য হতে পারে। যেহেতু শাস্ত্র সম্পর্কে আমার জ্ঞান তুচ্ছাতিতুচ্ছ, তারপরও হিন্দু পরিবারে জন্ম এবং বড় হওয়ায় এটুকু অন্তত জানি যে, পিরিয়ডকে কতোটা ‘অচ্ছুত’ হিসেবে গণ্য করা হয়, এটা ধরা যাবে না, এটা ছোঁয়া যাবে না, এদিক মাড়ানো যাবে না, আরও কতশত নিদান। যদিও আমার মা এসবের ধার ধারতো না, কিন্তু অন্যরা তো আর বসে ছিল না, তারা শিখিয়ে দিয়েছে, মানি বা না মানি, তা আমার বিষয় ছিল। পিরিয়ড নিয়ে তো কথাই বলা হতো না আমাদের পরিবারে। যেন এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কিছুই হতে পারে না এই জীবনে। কী যে নিদারুণ কষ্টে কেটেছে কৈশোরের সেই দিনগুলি! লুকাতে লুকাতে যে ভয়াবহ ব্যাধি বাঁধিয়ে বসিনি, সেটাই রক্ষে!

ঋতুমতীদের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আচরণ নিয়েও আপত্তি রয়েছে স্বামী কৃষ্ণরূপ দাসজীর। তাঁর কথায়, ‘মহিলারা বোঝেন না, ঋতুস্রাব চলার সময়টা তপস্যা করার মতো। এ-ও শাস্ত্রে লেখা। আমারও এ সব বলতে ভাল লাগছে না। কিন্তু আমায় সতর্ক করতেই হবে। পুরুষদের উচিত রাঁধতে শেখা, এতে আপনাদের ভাল হবে।’
এখন চলুন, ধর্মগুরুর এই কথাটি একটু ভেবে দেখি। উনি বলেছেন, ঋতুস্রাব চলার সময়টা তপস্যা করার মতোন। তপস্যা মানে আরাধনা না হলেও এই সময়টাতে যে সব নারীই নাজুক থাকে শরীরে, সে তো আর অজানা নয়। তাকে যদি তখন দৈনন্দিন এসব কাজ থেকে মুক্তি দেয়া যায়, বা হয়, তাতে আখেরে লাভ তো আমাদেরই! আমরা তো এটাই চাইছি দীর্ঘদিন থেকে। নয় কি!

পরের কথাগুলোও শিরোধার্য করলে কিন্তু নারী অধিকারের অনেকটা পথই সুগম হয়ে যায়। অযথা ট্রল না করে, অযথা বেহুদার মতোন শিরোনাম না করে তাঁর এই বক্তব্যটিকেই যদি আমরা সামনে নিয়ে আসি, তবে কী দেখি! উনি পুরুষদের রান্না শিখতে বলেছেন। নারীর ওপর অযথা নির্ভরতা থেকে মুক্তি দিতেই কিন্তু এই বলা।

সাংবাদিকরা যখন জেনে যায় কোন শিরোনাম করলে মানুষ খাবে, কাটতি হবে, তারা তাই করে। আবার ধর্মের দোহাই দিয়ে যখন এই সময়ে এসেও কাউকে এসব হাবিজাবির সাথে তুলনা করে মূল কারণটা ব্যাখ্যা করতে হয়, তাতে আমাদের দৈন্যই প্রকাশ হয়। ধর্ম দিয়ে এখনও যে জাতিকে বোঝাতে হয়, সেই জাতি কতদিনে মুক্তি পাবে, আদৌ পাবে কীনা, তা বলাই বাহুল্য।

মানুষ শিরোনাম পড়েই ছি ছি করছে, ভিতরে পড়ছে না বা এর গূঢ়ার্থ অনুধাবন করছে না। একটা অন্ধ এবং বন্ধ্যা সমাজে এখনও এই ভাষায় কথা বলতে হয়, এটাই তো ভয়াবহ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.