সুরঞ্জনা মায়া:
পৃথিবী জুড়ে এতো মানুষ, কিন্তু কারো জীবনের সঙ্গেই কারো জীবন মেলে না। একেক জনের জীবনের ধারা একেক রকম। মেয়েদের জীবনের কথা কোন পুরুষের পক্ষে এতো সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। যেভাবে একজন নারী লেখক নিপূণভাবে তুলে ধরতে পারেন। ‘চৌখুপি জীবন’ উপন্যাসে সালমা লুনা খুব সুন্দরভাবে তা তুলে ধরেছেন।
প্রতিটি মানুষের মনের গভীরে লুকোনো একটি সিন্দুক থাকে। যার ডালা সব সময় খোলা হয় না। জন-সম্মুখে তো নয়ই। মাঝে মধ্যে নির্জনে সন্তর্পণে সুগন্ধী চন্দন কাঠের মতো স্মৃতির সেই সিন্দুক খুলে আমরা নাড়াচাড়া করি, আবার সাবধানে তা বন্ধ করে রাখি।
ইশরাত, রুবী, সুবর্ণা, অরুণা আত্মনির্ভরশীল, স্বাধীনচেতা প্রাপ্তমনস্ক চারজন বন্ধু একান্তে ছুটি কাটাতে শহরের কোলাহল থেকে দূরে নির্জন এক গ্রামের বাগান বাড়িতে যায়। প্রকৃতির কাছে গেলে মানুষ প্রকৃতির মতো উদার, খোলামেলা হয়ে যায় নিজেরই অজান্তে। প্রকৃতির সরলতার মাঝে মেকি আবরণে ঢাকা চেহারা বেশি সময় ধরে রাখা যায় না। তাই একেক জনের কাছে একেক জনের সত্য চেহারা ধরা পড়ে যায়। কারও কারও উপলব্ধি হয়- আসলে গাছ তো মানুষেরই মতো। কিংবা মানুষ গাছের মতো। গাছের সাথে মানুষের অনেক মিল। শেকড়বাকড়ের ঘর-সংসার। পাতা, ফুল, ফল, ঝরে পড়া, মরে যাওয়াও। যত্ন না পেলে গাছ মরে যায়। ভালবাসা না পেলে মানুষের মনও রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে যায়।
পৃথিবীতে স্বাভাবিক নরনারীর মধ্যকার সম্পর্কের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো এরা সঙ্গীর শরীর আর মনে একই সাথে প্রবেশাধিকার পায় না। কেউ শুধু শরীরের দখল পেয়ে সুখে থাকে, কেউ মনের ঘরে চিরজীবন দখলদারী করে যায় যা জানতেও পারে না। অল্প কিছু সৌভাগ্যবান আছে যারা নিজেদের সংগীর শরীর আর মনের রাজত্ব করে যায় আমৃত্যু। কিন্তু প্রকৃতি হয়তো তাদের সেই সৌভাগ্য মেনে নিতে পারেনা। তাই এই রাজত্বের খবর রাখার দায় থেকেই তাকে অব্যাহতি দেয়।
এমন গভীরভাবে মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক দিক তুলে ধরেছেন লেখক। প্রেম, যৌনতা, পরকীয়া এসব অনায়াসে তুলে ধরে লেখক সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। সমাজ, সংসার, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, সুখ, দুঃখ সব নিপূণতায় ছবির মতো এঁকে গিয়েছেন সাবলীলভাবে।
বেড়াতে গিয়ে চার প্রকৃতির চারজন নারী কখনও এক সঙ্গে গলা মিলিয়ে হেসেছেন, কখনও একে অপরের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন, কখনও বা ঘৃণাও করেছেন। কিন্তু ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় সম্মোহিত হয়ে তারা একে একে বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা চন্দন কাঠের সিন্দুক খুলে একান্ত কথা-মালাগুলো সবার সামনে নিয়ে আসে। চাঁদের আলো চার বন্ধুকে পরম যত্নে আলোর মায়ায় জড়িয়ে কাছাকাছি নিয়ে আসে।
চাঁদটা হয়তো আবার আসবে, হয়তো এভাবে নয়, অন্য কোন ভাবে আসবে। সেদিনও হয়তো তার আলোতে অন্য রহস্যময় ছবি আঁকা থাকবে। চাঁদের আলোয় থাকবে অন্য কোন মানুষ! তারাও হয়তো এই চার বন্ধুর মতো ভেঙ্গেচুরে নিজেদের আবিষ্কার করে নেবে। সব কিছু বদলে গেলেও আকাশ আর চাঁদ একই রকম থাকবে।
ঝরঝরে প্রাঞ্জল ভাষায় উপন্যাসের হাতেখড়িতে সালমা লুনা যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বইটি কিনুন, পড়ুন। অবশ্যই ভালো লাগবে।
বই – চৌখুপি জীবন।
লেখক- সালমা লুনা
প্রকাশক- সুচীপত্র।
পাবেন- স্টলঃ গতিধারা ৫১৪-৫১৬
ও রকমারি ডট কম।