সালমা লুনা:
“কী করে বোঝাই- পিসিমনিদের শঙ্খ পড়ে ছিলো অনাদরে, কেউ যদি নিয়ে যেত?”
এটুকু অবধি পড়েই টের পেলাম চোখে জল জমছে।
এভাবেই চোখের জল নিয়ে পড়া শুরু হলো সুরঞ্জনা মায়ার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ মুলক বই ১৯৭১ কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ।এগারো বছরের এক কিশোরী, তার পরিবারের সাথে বাংলাদেশের জন্ম প্রত্যক্ষ করেছেন। পালিয়ে পালিয়ে থেকেছেন। নিজেদের বাঁচাতে ছুটে গেছেন এদিক-সেদিক। সেই ভয় সেই আতঙ্ক আর মুক্তিযুদ্ধকে কিশোরী যেভাবে তার ভেতরে ধারণ করেছেন তাই আজ পরিণত বয়সে এসে এই গ্রন্থে সাধারণ ভাষায় বলে গেছেন।
আমরা সাধারণত মুক্তিযুদ্ধের গল্প উপন্যাস বা স্মৃতিকথায় যা পড়ি তাতে ওই সময়ের ছোট ছোট এই মানুষগুলির কথা বিশেষ জানা যায় না। স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্ম শুধু বড়দের কথায়, বড়দের স্মৃতি থেকে তাদের চোখ দিয়ে দেখে এসেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে। আমাদের প্রিয় দেশটার জন্ম ইতিহাস জেনেছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছোটদের মনে কীভাবে দাগ কেটে গেছে তা জানা হয়নি খুব একটা । তাদেরকে কীভাবে এক টানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অতি নির্মম এক বাস্তবতার মুখোমুখি, সেটি তাদের জবানিতে শোনা হয়েছে খুবই কম। খুব কম লেখালেখি আছে এই নিয়ে। নগণ্য সংখ্যক কাজ হয়েছে এই নিয়ে।
বইটা সম্পর্কে জানা হয়েছিল আগেই। তাইতো একটানে বসেই পড়ে ফেললাম আর লেখকের সাথে আমি যেন সেই সময়টাকে প্রত্যক্ষ করে এলাম। না দেখা সেই যুদ্ধটা যেন আমার সামনে একেবারে বাস্তব হয়ে উঠলো।
লেখার ভাষা খুবই প্রাঞ্জল।
ছোট ছোট বাক্যে স্মৃতিচারণের মতোই লিখে গেছেন, যা পড়তে খুবই আরাম লেগেছে।কিছু জায়গা হৃদয়কে ঠিক ছুঁয়ে গেছে বলব না, একেবারে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
জানলা দিয়ে বাড়িওয়ালার বাড়িতে পিসিদের বাড়ির কৃষ্ণ ঠাকুরের ভোগের থালাবাসন দেখতে পেয়ে লেখকের মনের তোলপাড়। স্বাধীনতা লাভ করার ঠিক আগ মুহূর্তে এন্দ পরিবারের করুণ পরিণতি। স্বাভাবিকভাবে ঈদ করতে না পেরে কিশোরী মনের টানাপোড়েন।
পড়তে পড়তেই জেনেছি সেই অমোঘ সত্য, রাজাকার আর শান্তিকমিটি নামের ঘরের শত্রুরা কীভাবে স্বাধীন দেশে শুধু ঠাঁই পায়নি, প্রতিপত্তিও পেয়ে গেছে মৃত্যুর আগে।
সত্যিই মনে রয়ে যাবে বহুদিন।পড়তে পড়তে আমিও যেন এক আকুল কিশোরী হয়ে উঠলাম যে লেখকের পিসিদের বাড়ির সেই শঙ্খ কুড়ানোর মতোই আবার কুড়িয়ে নিলাম আমার স্বদেশপ্রেমটুকু।
থাক, আজীবন ওইটি যে আমার সঙ্গী হয়েই থাকবে আবারও টের পেলাম।
সেজন্যই লেখককে ধন্যবাদ।
লেখককে আরও ধন্যবাদ জানাই এমন একটা ছোট্ট দলিল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে দিয়ে যাবার জন্য। তারা পড়ে অন্তত জানবে কত কষ্ট করেই না এসেছে আমাদের এই স্বাধীনতা।
যদি একজনও ভাবে এমনটা। যদি একজনও একটু বেশি ভালোবাসে এই দেশটাকে, যদি একজনও এই স্বাধীনতার মূল্য দেয় তবেই সার্থক হবে এই প্রচেষ্টা।
আমার ধারণা এমনটা হবে।আর তাই আমি পাঠকদের বলবো, কিশোর বয়সীদের হাতে তুলে দিন এমন বই। তারা জানুক মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে স্বাধীনতা এসেছে দেশে এবং এই যুদ্ধটাতে আমাদের মত সাধারণ মানুষও ছিলো। অবর্ণনীয় কষ্ট করেছে সবাই।
আর তাইতো পেয়েছে এই স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। আর পেয়েছে চমৎকার একটি লালসবুজ পতাকা।বইয়ের নাম: ১৯৭১ কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ।
প্রকাশনী: এক রঙা এক ঘুড়ি প্রকাশনী।
বইমেলায় ৫৮৭ নং স্টলে পাওয়া যাচ্ছে বইটি।
সুরঞ্জনা মায়ার ১৯৭১ – কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ
শেয়ার করুন: