নারীবাদী প্রস্তাবনা: একটি বই পর্যালোচনা

সারোয়ার তুষার:

বীথি সপ্তর্ষির বই। নাইজেরিয়ান ফেমিনিস্ট চিমামান্দা এনগোজি অ্যাদিচে’র দুটো ছোট ছোট পুস্তিকা ‘We Should All be Feminists’ ও ‘A feminist Manifesto in fifteen suggestions এর অনুবাদ সংকলন।

চিমামান্দা এনগোজি অ্যাদিচেকে বলা যেতে পারে ব্ল্যাক ফেমিনিজমের একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম পাইওনিয়ারদের একজন। ব্ল্যাক ফেমিনিজম বহু আগেই হোয়াইট ফেমিনিজমের সাথে জড়িয়ে থাকা সুপ্রিমেসি, ক্লাস প্রিভিলেজ ও লিবারেলিজমের সীমাবদ্ধতা ও ক্রিটিক হাজির করেছে।

চিমামান্দা আমার কাছে একেবারেই নতুন; যতটুকু বুঝতে পেরেছি ইউরোসেন্ট্রিক ফেমিনিজম তো বটেই, ব্ল্যাক ন্যাশনালিস্ট পলিটিকস এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এর মত কালোদের মানবাধিকারের ব্যাপারে সরব প্ল্যাটফর্মগুলোর সাথে লেপ্টে থাকা সেক্সিজম, লৈঙ্গিক নিপীড়নকে মোকাবেলার প্রতি প্রবল ঝোঁক চিমামান্দার।

এটাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কেন? কারণ বাংলাদেশে নারীবাদ কিংবা নারীমুক্তি’র যে ধারাটি প্রধান হয়েছে সেটি ইউরোপের লিবারেল নারীবাদের অপভ্রংশ। এই নারীবাদের (খোদ ইউরোপেই) ঐতিহাসিক প্রস্তাবনা সামাজিক স্তর, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, সস্তাশ্রম উৎপাদন, শ্রম-বাধ্য শ্রমকে দেখতে পায় না। দেখতে পায় না এর ফলে সৃষ্ট বৈষম্যকে। প্রাচীন প্রতিষ্ঠান পরিবার, শ্রম ও যৌন দাসত্ব যুগ থেকে আধুনিকায়নের সঙ্গে কেমন করে আধুনিক শ্রম-দাসত্ব ও যৌন-দাসত্ব সৃষ্টি করে তাকে আড়াল করে।

এই ধারার নারীবাদের সর্বোচ্চ অর্জন লিবারাল সংবেদনশীলতা। লিবারালিজমের সবচেয়ে বড় অভিঘাত ছিল ফরাসি বিপ্লব। বাট আইরনি হলো, পশ্চিমে ফরাসি বিপ্লবের একশ বছরের বেশি সময় পরেও নারীকে ভোটাধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে ।

ঐতিহাসিকভাবে লিবারালিজমে নারী মুক্তি ততটুকু যতটুকু ধর্মীয় চার্চের বিধি বিধান আর কর্তৃত্ব থেকে সে মুক্ত হয়। আবার একই সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে আধুনিক রাষ্ট্র ও আইন কানুন জুরিসপ্রুডেন্সের মধ্যে গড়ে ওঠা ‘অধিকার’ কে সে প্রশ্ন করে না। তার আলোচনার টার্গেট হয় সামন্ত ধর্ম ও তার অবশেষের মধ্যে বেড়ে ওঠা পুরুষতন্ত্র, যাকে কিনা আবার এই আধুনিক রাষ্ট্র আর নিওলিবারাল পুঁজিবাদই পুষ্টি দেয়। ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রের জটিল মতাদর্শিক হাতিয়ার হিশেবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা চিহ্নিত করতে সে ব্যর্থ হয়।

হাজার হাজার বছর ধরে প্রবাহমান নারীর শ্রম দাসত্ব, যৌন দাসত্বের বিপরীতে স্বেচ্ছাশ্রম ও সম্পর্কের স্বাধীনতার প্রশ্নটি উহ্য থেকে যায় লিবারালিজমে। পুঁজিবাদের মধ্যে গড়ে ওঠা লুম্পেনাইজেমনের হায়ারার্কিটাও সে চিনতে পারে না। শ্রম ও যৌনতার ডিনামিক্স পাল্টানোর প্রশ্নে তার কোন রূপকল্প নেই।

এই ধারা তার গৃহীত যুক্তি পদ্ধতিতেই কিন্তু শ্রম দাসত্ব ও যৌন-দাসত্বকে ঐতিহাসিকভাবে ক্রিটিক করে না। তবে সে নিজে ক্রিটিককে ওয়েলকাম করে, আমাদের এখানে যা কল্পনা করা যায় না। ক্রিটিক মাত্রই চক্ষুশূল, শত্রু।

আবার লিবারেলিজমের চিন্তাকাঠামোয়, যে বিশেষ শর্ত-পরিস্থিতি-ইতিহাসের ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে ব্যক্তির বিকাশ ঘটেছে, ‘অপশ্চিমা’ অঞ্চলে (পুরুষ) ব্যক্তির পক্ষে তা অসম্ভব, নারীর পক্ষে তা কল্পনাতীত।

অথচ লিবারেলিজম ঠিকই ইউরোপের ছাঁচে গোটা দুনিয়াকে শেইপ দিতে চেয়েছে। ফলে এই লিবারেল চিন্তাকাঠামোর সম্মতি ও মদদে, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিনে নির্মম ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন চলেছে শত শত বছর জুড়ে। উপনিবেশিত অঞ্চলের শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণের সংকটের স্তর ইউরোসেন্ট্রিক মতাদর্শ দ্বারা বোঝা সম্ভব হয়নি।

এই কারণেই উপনিবেশিত অঞ্চলের মানুষ হিশেবে চিমামান্দা নারীমুক্তির রূপকল্পে একদা উপনিবেশের শিকার নিজ ভূমের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন বলেই মনে হলো।

বাংলায় ‘অপশ্চিমা’, ‘ভয়েজলেস’ অঞ্চলে বিকশিত হওয়া, ক্রমাগত পশ্চিমের কাছাছোলা আধিপত্যকে নির্মম ক্রিটিক করা নারীবাদী টেক্সটের গুরুত্ব অপরিসীম। সেইরকম গুরুত্বপূর্ণ দুটো পুস্তিকার অনুবাদ হাজির করায় বীথিকে সাধুবাদ জানাই।

বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার গ্রন্থিকের (২১১) স্টলে।

শেয়ার করুন: