পরিবারের দায়িত্বশীল ছেলে

দিনা ফেরদৌস:

কিছু বিষয় আছে যা সর্বজনীন সুন্দর আর ভালোলাগার, যার বিপক্ষে বলার কোনো সুযোগ নেই ,ফলে বহু কিছুতে খটকা লাগলেও বলা যায় না। যেমন, আমরা প্রায়ই দেখি পরিবারের বড় ছেলে, বাবার অবর্তমানে বা বর্তমান থাকা অবস্থায়ও যদি বাবা কিছু না করেন, তো সেই ছেলেকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয়।

প্রতিটি সন্তানেরই উচিৎ সংসারের দায়িত্ব নেয়া। স্বাভাবিক নিয়মের ছোটদের পড়াশোনা শেষ হয় বড়দের পরে, তার আগ পর্যন্ত বড়দেরই দেখতে হয়। কিন্তু যখন কেউ বলে বড়ভাই পিতৃতুল্য বা বাপের মতো, কথাটায় আমার কঠিন আপত্তি আছে। বড়ভাই থেকে সব চেয়ে ছোট/ভাইবোনের বয়সের তফাৎ খুব বেশি হলে ১২/১৪ বছরের হতেই পারে (বিরল)। ৬/৭ বছরেরই হয় বেশি। বড় ভাই হিসেবে, ছোট ভাই/বোনের দায়িত্ব পালন এক বিষয়, আর নিজের থেকে ১২/১৪ বছরের ছোট ভাইবোনকে নিজের সন্তানের মতো করে দেখা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

ছোট ভাই/বোনেরা পিতার আসনে বড় ভাইকে বসাতে গিয়ে আদর, আবদারের নিজস্ব জায়গা বানিয়ে ফেলার পর, নিজেদের দায়িত্ব ফেলে গায়ে হাওয়া লাগাতে লাগাতে ভুলেই যান তারাও এই পরিবারের সন্তান, তাদেরও সমান দায়িত্ব আছে এই পরিবারের প্রতি।

দুধের বাচ্চারে রোস্ট খেতে দিলে, যা হয় আরকি। বুড়া বুড়া বাচ্চাদের বাপ হতে গিয়ে, সেই বাচ্চা বাপটা ভুলেই যায় নিজের অস্তিত্ব, নিজের আলাদা জীবন, রোমান্স, প্রেম, কামের কথা। এই সুযোগে বুড়া ভাই/বোনেরা অবুঝ হয়ে, লুকিয়ে বা প্রকাশ্যে প্রেম/কাম/ফ্যাশন/বন্ধুর আড্ডা সবই করে। কারণ তারা জানে এইসব সামাল দেবার জন্য আনস্মার্ট, বোকা, বোঝা বহনকারী এক গাধা আছে। যেই বেকুবের ঘাড়ে ভর দিয়ে এইসব ফুর্তি করাই যায়। সবই ঠিকঠাক চলে, সমস্যা হয় সেই বেকুবের যখন বীর্য শুকিয়ে যাবার সময় আসে, তখন সমাজকে দেখাতে তাকে বিয়ে দিতে হয়, না হলে লোকে নানাকথা বলে।

ফলে সেই বেকুব যখন বিয়ে করে, তখন তার বউ পুরো পরিবারের সতীন বা সৎ মা হয়ে আসে। সেই বেকুবের কাছে বউ তেমন গুরুত্ব পাবার কথা না, বুড়ো বয়সে বউয়ের কাছে যেতে বরং লজ্জাই লাগে, হীনমন্যতায় ভোগে সে, ইয়াংরা যেখানে সময় দেয় ৩০ মিনিট, সে ২ মিনিটেই কাম সারেন। তার রোমান্স করার টাইম থাকে না। তার নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে রাখার অনুমতি নাই। সে জন্ম থেকেই বাপ হয়ে আছে। বাপেদের ওসব থাকতে নেই। ২/১ টা বাচ্চা জন্ম দিয়ে এরা ভালো বাপ হয়, কিন্তু ভালো স্বামী বা প্রেমিক হয় না কোনদিন। এদের বউ পরিবারের সকলের কথায় উঠে বসে, কারণ এদের জন্য শিক্ষিত/চাকুরিজীবী, সুন্দরী/ স্মার্ট বা বড় ঘরের মেয়ে আনা হয় না, পারলে বাচ্চা মেয়ে খুঁজে আনা হয়; যে নিজের প্রতি অন্যায় হলে প্রতিবাদ করতে পারে না, নির্যাতন করলে সহজে বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে না সহজে। এদের বিয়ে করানো হয় নামে, আনা হয় ঘরের কাজের লোক হিসেবে। যাকে দিয়ে সারাদিন কাজ করানো হয়, পরিবারের সকলের মন যুগিয়ে চলার দায়িত্ব দেয়া হয়, তিন মিনিট বরের সঙ্গে বিছানায় গিয়ে বছর শেষে বাচ্চা জন্ম দিতে হয়।

এদের সবার কথা শুনে চলতে হয়। এদের চলায়, বলায়, উঠায়, বসায় ভুল থাকে। এদের বর কখনো বন্ধু বা সঙ্গী হয় না, হয় প্রভু। আর সেই প্রভু আমৃত্যু সারা পরিবার আগলে রাখতে রাখতে অবশেষে বাংলা সিনেমার আনোয়ার হোসেনের মতো যক্ষা রোগী হয়ে, মুখ দিয়ে রক্ত বা ফেনা বের হতে হতে একদিন মরে যায়। ততোদিনে পরিবারের অন্যরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে যার যার সুবিধামতো জায়গা করে নেয়। আর কেউ যদি না পেরে থাকে (বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এমন হয়, ধরেন বিয়ে হয়নি/ডিভোর্সি/বিধবা) তবে বড় ভাইয়ের বউ কোন কালেই সংসার পাবেন না নিজের করে। ব্যতিক্রমীও আছে, তবে সেটা আমার আলোচনার বিষয় নয়।

তাই আমি মনে করি, বড় ভাইকে বড়ভাই হিসেবেই দেখুন, পরিবারের অন্য সব সন্তানের মতো। যেই সংসারে অভাব অনটন আছে, সবাই মিলে কাজ করুন, পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি পেলেও করুন। নিজের হাত খরচের টাকা সব সময় নিজে চালাবার চেষ্টা করুন। বড় ভাই হলেও সে আলাদা একটা মানুষ, তার সাংসারিক জীবনে দখলদারি কম করেন। বাপ’কে বাপের জায়গায় রাখুন। যাদের বাপ নেই, বড় ভাই নেই, তাদের জীবন কি চলে না? অতিরিক্ত বারাবাড়ির ফলে এই ধরণের সংসারে ভাঙন ধরে। কখনো স্বামী-স্ত্রী মিলে আলাদা ঘর নিয়ে চলে যায়, কখনো বা স্বামী- স্ত্রীর মাঝেই ফাটল ধরে। তখন অবশ্য সেই পরিবারের লোকজন অপদার্থ, গাধা ছেলেকেই দোষতে থাকে।

এতো গেলো দেশে থাকা ছেলে আর বউদের অবস্থা। একই অবস্থা বিদেশে পাঠানো ছেলেদের ক্ষেত্রেও হয়। যাদের বাবা-মা জমিজমা খরচ করে বা অন্য যেকোনো উপায়ে ছেলে দেশের বাইরে পাঠান, তারা এরপর থেকে মনে করে বসেন এই ছেলের আর ভবিষ্যৎ কি, তাদের ভবিষ্যৎ গড়াই এই ছেলের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

সে গেছেই পরিবারের জন্য, তাই তার কাজ হচ্ছে, বাপের মামাতো শ্বশুরের শালীর চাচাতো বোনের মেয়ের ননদের বিয়েতে দামী উপহার দিয়ে, সমাজে মুখ রেখে চলা। আর নিজেদের পরিবারের বিয়ে হলে তো কথাই নেই, এক মাসেও বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে না। কে কতো দামী জামা, গহনা পরে দেখাতে পারেন বিদেশি টাকায়, তার প্রতিযোগিতায় নামেন। তার আগে বাড়ি বিল্ডিং করা তো আছেই, ফার্নিচার পরিবর্তন না করলে’তো আর ঘরে লোক বসানোই যায় না। আর সেই গাধা দিনে রাতে কাজ আর কাজ করে, ঘুমানোর সময়টুকুও পায় না। সে হয়তো বেইজমেন্টে বা স্টুডিওর রুমে থেকে জীবন পার করছে।

বউ বাচ্চা যদি থাকে তার সঙ্গে, তো সেই লোকের টাইম নাই বউ বাচ্চারে দেবার। বউয়ের পরিবার হয়তো বিদেশি পাত্র দেখে বিয়ে দিছে। কিন্তু এই বিদেশে মেয়েটি কী জীবনযাপন করছে, তা দূর থেকে দেখে কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না।

আমার মেসেজ হচ্ছে, যদি সন্তানকে বা নিজের বড় ভাইকে (সবক্ষেত্রে যে পরিবারের বড় ছেলে দায়িত্ব নেয় তা নয়, মাঝারি বা ছোটরাও নেয়, যে নেয় তার কথা বলতে চাচ্ছি) সত্যিই ভালোবেসে থাকেন, তবে তাকে তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন উপভোগ করতে দিন। তাকে কিছু স্পেস দিন। আপনারা যেহেতু বেহায়া, নির্লজ্জের মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে আরেকজনের ঘাড়ে সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে স্বপ্ন বুননের চেষ্টায় আছেন, থাকেন। সেখান থেকে নিজেরদের বিবেক জাগ্রত না হলে, আমার লিখা পড়ে গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠলেও, আপনাদের মনে একটুও দাগ কাটবে না, আমি জানি। কিন্তু নিজের ভাইকে অন্তত তার নিজের রুমে একটু আরামে থাকতে দিন।

আমি এখনো বহু ঘটনা প্রতিদিন শুনি যে, বেডরুমেও ওইসব গাধারা শান্তিতে থাকে না। নিজের রুমের দরজা লাগাতেও পুরো পরিবারের পারমিশন লাগে। এমনকি কতক্ষণ রুমে থাকবে তারও। নিজেরা তো সময় নিয়ে সঙ্গম করেন, ওদেরকে একটু করতে দিন।

পরিবারের বড় ছেলেকে অন্যান্য সন্তানের মতোই দেখুন। অন্যরা বড় হয়ে গেলে, আস্তে আস্তে পরিবারের দায়িত্ব ভাগ করে দেন, সকলের মাঝে। যে দায়িত্ব নিতে অনিহা করবে, তার সুবিধাও কমিয়ে দিন। শারীরিক বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী না হলে, পারি না বলে কোন কাজ নেই। আজ যেই ছেলে বা মেয়ে একগ্লাস পানি ঢেলে খায় না, সে বিদেশে গেলে বা শ্বশুরবাড়ি গেলে সব কাজ একাই করে। তাই আগে থেকে সংসারের সব কাজে, পরিবারের সব সন্তানকে যুক্ত রাখুন।

আর এডাল্ট সন্তানের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ বাদ দিন, সে কার সঙ্গে প্রেম করবে, কাকে বিয়ে করবে, সে সিদ্ধান্ত তাকে নিতে দিন। সময় গেলে কোন সাধনই ঠিকমতো হয় না (তার মানে বলছি না যে, ছেলের নিজের যোগ্যতা নেই নিজের পয়সায় বিয়ে করার বা বিয়ে করে নিজের টাকায় সংসার করার, সে হুটহাট বিয়ে করে আর একটা বেকার বোঝা সংসারের ঘাড়ের উপর এনে চড়ে বসবে)। তার জীবনটা তাকে নিজেরমতো সুন্দর করে সাজাতে সাহায্য করুন প্লিজ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.