
সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়: ১৫ আগস্ট৷ ভারতের স্বাধীনতা দিবস। অনেক রক্তপাত, বহু সংগ্রাম, তীব্র অমানবিক আচরণ সহ্য করার পরে এসেছিল এই স্বাধীনতা৷ ১৯৪৭ – এ। সে এক উজ্জ্বল অথচ অন্ধকার ইতিহাস।
উজ্জ্বল এইজন্য যে স্বাধীনতা এক অনন্য সাধারণ প্রাপ্তি। অন্ধকার এইজন্য যে, এই স্বাধীনতার বিনিময়ে দেশভাগ হওয়া। সেই দেশভাগ যদি ভৌগলিক বা মানবিক ভাগ হত, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না৷ এমন বিশ্বের বহু প্রান্তে হয়েছে, আজও হচ্ছে৷ এই দেশভাগের কলঙ্ক এখানেই যে এই ভাগাভাগির নেপথ্যে ছিল ধর্মের ভিত্তি৷ যে ধর্ম আজও ছড়ি ঘোরাচ্ছে৷ ১৯৪৭ এর দেশভাগের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন বেঁধেছিল রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা৷ পারস্পরিক হানাহানি৷ লক্ষ লক্ষ পরিবারের আর্থসামাজিক ভিত্তি চৌচির হয়ে যায় সেদিন৷ নারী-শিশু থেকে শুরু করে উপমহাদেশের হাজার হাজার মানুষের জীবন যায়৷
একটি পরিসংখ্যান বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও ব্রিটেনের মোট সৈন্যক্ষয়ের থেকেও ’৪৭ এর দাঙ্গার বলির সংখ্যা ছিল বেশি৷ সেই দেশভাগজনিত দাঙ্গা কিন্তু সেদিনেই মিটে যায়নি, তার প্রভাব আজও চলেছে৷ যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তাতে রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছে, মানুষ স্বাধীন হয়নি৷ ভারতের দিকে তাকালে, তার ইতিহাসের দিকে কিছুটা খতিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাব, বারে বারে এই ভূখণ্ডের ওপরে বিভাজনের প্রভাব পড়েছে, তাতে এই ভূখণ্ডের একটি নিজস্ব চরিত্র গড়ে উঠেছিল৷
তথাকথিত খৃষ্টিয় শতক সভ্যতার মাপ অনুযায়ী বিগত দুই সহস্রাব্দের ইতিহাসে দেখা যায়, ভারত ভূখণ্ড হিসেবে সব সময়েই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রাজা বা সম্রাটের শাসনে থেকেছে৷ প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে পুরুরাজ কণিষ্ক, তারপরে সমুদ্রগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত ( আনুমানিক ষষ্ট খৃষ্টাব্দ), পরে মৌর্য সম্রাট অশোক, যিনি কিনা চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হয়ে বুদ্ধের বাণীর ভিত্তিতে সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন, এই কয়েকজন চক্রবর্তী সম্রাটের হদিশ দেয় ইতিহাস৷ বাকি সকলেই একে-অপরের সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহে ব্যস্ত থেকেছেন, কোন না কোনভাবে নিজ রাজ্যের সীমানা রক্ষা করেছেন কিংবা বাহুবলে সেই সীমানা কখনও বেড়েছে , কখনও কমেছে৷
মোট কথা, ভারত ভূখণ্ডের নিয়তি এমনটাই যাতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র সেখানে কখনওই গড়ে ওঠেনি৷ বা গড়ে উঠলেও তা দীর্ঘ সময়ের জন্য এক জায়গায় থাকতে পারেনি৷ সম্রাট আকবরের সময়ে যে মোঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃতি লাভ করেছিল, তারপর থেকে তা ক্রমশ কমেছে৷ আওরঙ্গজেব রণপান্ডিত্য দেখিয়ে সেই সাম্রাজ্যকে খানিকটা বশে আনলেও উপবিপ্লবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাননি৷ যে কারণে আমৃত্যু লড়াই করে যেতে হয়েছে তাঁকেও৷ কারণ ওই একটাই, সাম্রাজ্যকে এক ছাতার তলায় রাখা৷ আর তাঁর মৃত্যুর পর থেকে মোঘল সাম্রাজ্যের ভাঙন আর রোধ করতে পারেননি পরবর্তী সম্রাটদের কেউই৷ শেষে তো সেই ইংরেজের হাতে যাবতীয় স্বত্ত্ব তুলে দেওয়া, বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে৷
ইংরেজও কিন্তু তাদের শাসনের গোড়ার দিকে দেশীয় রাজাদের ওপরে কোনরকম বীরত্ব দেখাতে যায়নি, কারণ এই বুদ্ধিমান আর সাম্রাজ্যবাদী জাতিটি তাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে দিব্যি জানত, স্থানীয় সেন্টিমেন্টে হাত দিতে নেই৷ তাতে হাত পুড়ে যাওযার আশঙ্কা থাকে৷ সে কারণেই পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে এইসব রাজাদের তারা ক্ষমতাচ্যুত করেছে অনেক ছলে-বলে এবং প্রভূত কৌশলে৷ আর আজকের এই সার্বভৌম ভারতের ধ্যান-ধারণা, এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সূচনাও তাদের হাত দিয়ে৷ যে পদ্ধতিটিকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করে নেন স্বাধীনতার সনদে সই করা নেতারা৷ কিন্তু সেদিন তাঁরা একবারও ভাবেননি, এই দেশভাগের আর ধর্ম ভিত্তির মূল্যে যে স্বাধীনতা তাঁরা কিনছেন, তাতে জাতিতত্ত্ব কী তীব্রভাবে ধিকৃত হচ্ছে৷ তার কুফল জাতিগত দ্বন্দ্বের কোন রক্ত কর্দমময় পাঁকে পুঁতে যেতে পারে! আসলে ভারত এমনই একটি ভূখণ্ড, যেখানে মহাচীনের মত এক সাম্রাজ্য, এক ভাষা, এক সংস্কৃতির ধারণা কোনদিন স্ফূর্তি পায়নি৷ বিভিন্ন সময়ে যে কারণে নানা ভাষা, নানা সংস্কৃতি, বিভিন্ন চেতনা একজোটে এতে পুষ্টি পেয়ে এসেছে৷
সেই সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, তখন মানুষের স্বাধীনতা মূল্য পেত৷ রাষ্ট্রের ধর্ম হয়তো বা আজকের মত পুঁজিবাদী এবং নীচ দুর্নীতি নির্ভর শাসনযন্ত্র হয়ে ওঠেনি, কারণ সেই সমাজের ভিত্তি ছিল অন্যরকমের৷ তার প্রভাব ছিল আলাদা ধাঁচের৷ যে কারণে আজও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এই মস্ত বড় দেশের এধারে-ওধারে মাথাচাড়া দিচ্ছে, দেবেও৷ অভ্যন্তরীণ সমস্যার এই দুর্ভোগ আমাদের বারে বারে মেনে নিতে হয়েছে এবং হবে৷ কিছু ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর কিছু অবিমৃষ্যকারী আগামীর পরিকল্পনার কুফল ভুগে যেতে হচ্ছে এই ভূখণ্ডকে সুদীর্ঘকাল ধরে৷
এখানে একটা ছোট্ট উদাহরণ টানতে ইচ্ছে করছে, তা আবার পশ্চিম দুনিয়া থেকেই৷ ইউরোপের দিকে তাকালে যা আমরা দেখতে পাই, সেই একই আকৃতি কিন্তু উপমহাদেশেরও৷ তাই একই রকমভাবে বিভিন্ন পৃথক পৃথক জনগোষ্ঠী, তাদের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন, তাদের আচার আর দেশাত্মবোধ ভিন্ন ভিন্ন, তাদের সংস্কৃতিও আলাদা আলাদা৷ কিন্তু তারাও কখনও কোন একচ্ছত্র রাজ চক্রবর্তীর আনুগত্য মেনে নেয়নি৷ যখনই এমন চেষ্টা হয়েছে, শেষে তার পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ৷
উদাহরণ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ সাম্রাজ্যবাদ যেখানে মাথাচাড়া দিয়েছে, জনগোষ্ঠী সখানে বিপ্লব করবেই৷ উদাহরণ, রাশিয়া৷ বামপন্থী সমাজবাদের একটি মতবাদকে আশ্রয় করে, সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে কিছু দেশকে একটা শাসনযন্ত্রের পদানত করে রাখা গেছে বটে, কিন্তু শেষে তা ভেঙে গিয়েছে শুধুমাত্র ওই জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যের দাবিতে৷ কারণ, মানুষ শেষমেশ স্বাধীনতা চায়৷ শাসনযন্ত্রকে সেই দাবি মানতেই হয়, আজ অথবা কাল৷
ইউরোপের পূবে আর পশ্চিমে তাকিয়ে এখন কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, ছোট্ট ছোট্ট জাতি নির্ভর দেশ। তারা সকলে স্বাধীন, সকলে সার্বভৌম, কেউ একে-অপরের সঙ্গে অধিকার, জমির সীমা বা সম্পদ নিয়ে লড়াই করছে না৷ একটি ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে, যা পরস্পরের বৈশিষ্ট্যকে সম্মান জানাচ্ছে, একে অপরের বিপদে সহায়তা করছে, ধীরে ধীরে এক অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা প্রসার লাভ করছে৷ শোষণ যে নেই, তা বলতে পারি না, ডারউইনের নীতি মেনেই বড় ছোটকে চুষে খায় বটে, তারপরেও কিন্তু, লিস্টেনস্টাইন বা লুক্সেমবুর্গের মত ছোট্ট একটা দেশে গিয়ে যখন দেখি একটি শহর আর চারটে গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা একটা দেশের, গাড়িতে চড়ে মাত্র ৪৫ মিনিটে যে দেশটা পুরোটা চক্বর দিয়ে আসা যায়, সেই দেশেরও ছোট্ট একটি ফুটফুটে ডল পুতুলের মত মেয়ে পার্কে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে দেশীয় ভাষায় একটা গান গাইছে, তখন বুকটা ভরে ওঠে আনন্দে৷
মনে হয়, এই এরকম নির্ভার স্বাধীনতাই তো আমরাও চেয়েছিলাম৷ আমরাও পেতে পারতাম৷ কিন্তু তা হল কই? মডেল-ফডেল দিয়ে কাজ নেই, আজকের উপমহাদেশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, জাতিগত ভিত্তিতে, ভাষাগত ভিত্তিতে, সংস্কৃতিগত ভিত্তিতে যদি এই সরস, প্রচুর প্রাকৃতিক সম্ভারে ভরপুর, উর্বরা, সুফলা ভূখণ্ডকে ভাগ করে দেওয়া যেত সেদিন? ওই ১৯৪৭ সালে? তাহলে এতদিনে আমরাও কী এমনটাই স্বাধীন হতে পারতাম না, যেখানে আমার ঘরের মা-বোনেরা, আমার ছোট্ট মেয়েটা ওই লুক্সেমবুর্গের মেয়েটার মতই নিশ্চিন্তে একটা পার্কে গিয়ে খেলতে পারত? আমিও জানতাম, ধর্মের কারণে বা লালসার কারণে কেউ তার ওপর অত্যাচার করবে না৷ কারণ, আমাদের মধ্যে তো সেই বিভাজনটা, সেই লোভটা নেই! দুর্নীতি নেই, মিথ্যা নেই, হানাহানি নেই, আছে অমলিন পারস্পরিক বিশ্বাস, আছে, শ্রদ্ধা, আছে ভালোবাসা, আছে মানবিক আচরণ৷ যে চোহারাটা দেখতে পাই পাশ্চাত্ত্যের এতগুলো দেশের মধ্যে৷ যারা তাদের ঝগড়াঝাটি মনে রাখেনি, শত্রুতা ভুলে গিয়েছে, ধর্মের ভিত্তি নিয়ে একে অপরের মাথা কাটতে ছোটে না৷
তাই বলি, স্বাধীনতা সুমহান৷ তবুও কেন জানি না, দাবি করতে ইচ্ছে করে, মানুষের স্বাধীনতার৷ কল্যাণ রাষ্ট্রের আর ধর্মপ্রভাব বিহীন এক স্বাস্থ্যবান, শিক্ষিত সমাজের৷ যে সমাজ সততই এবং সত্যই স্বাধীন হতে পারত৷
লেখক পরিচিতি: জার্মানী প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক এবং নাট্যকার।