মনের রং বদল

শাহরিয়া দিনা:

মানুষ প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির পালাবদলে ঋতুর পরিবর্তনে দিনগুলো ভিন্ন ভিন্ন আদল পায়। মানুষও ব্যতিক্রম নয়। সময়ের সাথে বদলে যায় মানুষের আকৃতি এবং প্রকৃতি। আকৃতি’র পরিবর্তন দৃশ্যমান, প্রকৃতি বা স্বভাবের পরিবর্তন অদৃশ্য তাই বাইরে থেকে বুঝতে পারাটা বেশ কঠিন। আবেগ এবং আচরণের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানই কাম্য আর সেই ভারসাম্য আনতে বিবেকের প্রয়োজন। আবেগ বা ইমোশন বলতে মানুষের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, রাগ, জেদ, হিংসা, অহংকার ইত্যাদি।

মন না মস্তিষ্ক কোথায় জন্মে মানুষের সব ইমোশন? পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক থাকতে পারে তবুও আমরা ধরে নেই মন-ই সমস্ত ভালোলাগা ভালোবাসার উৎস। ডোপামিন হরমোনের উঠানামার বিশ্লেষণ কিংবা হার্টের কাজ শুধুই শরীরের প্রয়োজনীয় রক্ত পাম্প করা তা গবেষকরা গবেষণা করুক আমরা বরং আজ হৃদয়ের কথা বলি।

শাহরিয়া দিনা

যে হৃদয়ে ভালোবাসার বসবাস, সেখানেই আবার হয় ঘাস। আজ যাকে ছাড়া বাঁচবো না মনে হচ্ছে কাল আবার সে ছেড়ে গেলেই বাঁচি মনে হয়। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখবেন হৃদয়ের টানাপোড়েন আর সংসারের ভাঙন নিয়ে অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।

ধরে নেই, বড় কোন অসংগতি ছাড়া আপনারা মোটামুটি তথাকথিত প্রচলিত সামাজিক মাপকাঠিতে সুখী দম্পতি। নীতিগতভাবে সম্পর্কের প্রতি বিশ্বস্ত এবং শ্রদ্ধাশীল। তবুও এমনকি হয়না, এক সময় আর সেই মুখটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করেনা, কারন এই মুখের মানচিত্র পুরোটা তো আপনার নখদর্পনে। তার হাত ছুঁয়ে আর আগের মতো শিহরণ জাগেনা, কেননা এটা এখন অভ্যস্ততা।

এর মাঝেই চলতে চলতে হঠাৎ খুব ভালো লেগে গেল কাউকে৷ তাকে ভাবতে ভালো লাগছে, দেখতে ইচ্ছে করছে, তার সামনে গেলে বুকের ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে ঠিক প্রথম প্রেমের মতো। আপনি হয়তো নিজের এই মানসিক অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হচ্ছেন, লজ্জা পাচ্ছেন কিন্তু এমন হয় তো। নাহ! এটাতে দোষের কিছু নেই। মানুষ তো, হতেই পারে এমন। কখন যে কি ভালো লাগে আমরা কেউ-ই তা জানিনা। আর মনের ভালোলাগার উপর তো কারো নিয়ন্ত্রণ নেই তাইনা!

তো, এই মনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানো অবস্থায় আমরা সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলি। ভুলে যাই আমাদের সংসারের কথা, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা। যেখানে, বাবা-মা একত্রে থেকেও সন্তানদের নিরাপদ রাখতে পারছে না সেখানে তাদের আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়া। আদরে-আহ্লাদে থাকার কথা যেই নিস্পাপ মুখগুলোর, তাদের চোখেমুখে দেখা দেয় অসহায়ত্বের রেখা।

একটা মনের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে অনিরাপদ আর এলোমেলো হয়ে যায় কয়েকটা জীবন। জীবন একটাই, সেটা নিজের মতো কাটানো যেমন ব্যক্তির অধিকার তেমনি যাদের সাথে জীবন জড়িয়ে আছে তাদের কথা চিন্তা করাও দরকার। কাউকে হতাশা আর অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দিয়ে নিজে সুখের সমুদ্রে ভাসবো ব্যাপারটা এত সহজ তো না। একটা অসুস্থ সম্পর্ক যেমন অনেক অসুস্থ ঘটনার জন্ম দেয় তখন ছেড়ে আসাই একমাত্র সমাধান। তেমনি একটা সুস্থ সম্পর্ক শুধুমাত্র মনের খেয়ালে ভেঙ্গে দেয়ার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকতে পারেনা।

একটা ব্যাপার মনে রাখা উচিৎ, আজকে যার প্রতিটা কথা এবং আচরণ দেখে আপনি মুগ্ধ হচ্ছেন ঠিক একইরকম মুগ্ধ হয়েছিলেন পুরণো মানুষটা প্রতি। কাব্য করার মতো কপলের তিল বা গালের টোলও পানসে হয়ে গেছে এতদিনে। ঠিক একইভাবে, নতুন চেহারাটাও এক সময় মূখস্ত হবে। পাশে থাকাটাও অভ্যস্ততায় পরিনত হবে।

যদি সৌন্দর্য ভালোবাসার উৎস হতো তবে জগতে কোন বয়স্ক দম্পতি দেখা যেত না, যদি টাকা- ক্ষমতা ভালোবাসার কারন হত, তবে কোন মধ্যবিত্ত বা নিন্মবিত্তকে কেউ ভালোবাসত না। ভালোবাসার মেয়াদ উত্তীর্ণের নির্দিষ্ট তারিখ থাকে না তবুও মাঝে-মধ্যেই পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতো রি-নিউ করতে হয় তা। অযত্নে চারাগাছটা মরে যায় তেমনি যত্নে মহীরুহ হয়।

হিমুর হাতে সেই পাঁচটি নীলপদ্মের থিওরির মতো আমরা প্রত্যেকেই যদি পাঁচটি নীলপদ্মের মালিক হই তবে তা শুধু একজনকেই দেয়া সম্ভব। কিন্তু এখকার বাস্তবতায় মনে হয়, কেউ কেউ পাংগাস কিংবা তেলাপিয়া মাছের মতো নীলপদ্মের চাষ করেন। কারো মন আবার টিকটিকি’র লেজের মতো। ছুঁয়ে দিলেই পড়ে যায়, কয়েকদিন পর নতুন করে আবার গজায়।

শখের জামা, ঘড়ি, মোবাইল ফোন সবকিছু একইরকম আকর্ষণীয় থাকে না চিরদিন। এই পৃথিবীতে সব নতুনই একদিন পুরনো হয়, সব পুরনো একদিন নতুনই ছিল। আজকে হঠাৎ যাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে তেমনিভাবেই কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল পুরনো মানুষটাকেও।

কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে সম্পূর্ণ আপন করে পাবার পর আমাদের মনে থাকে না এই মানুষটিকে ছাড়াই একদিন আমার নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছিল।
পেয়ে যাবার পর আমরা ভুলে যাই, কাছের মানুষটির হাতে হাত রেখে চলতে হয় পাশাপাশি।
আগলে রাখতে হয় বুকের কাছাকাছি।
মাঝেমধ্যে অবাক করে দিয়ে বলতে হয়, ‘তোমাকে খুব ভালোবাসি’!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.