ইমতিয়াজ মাহমুদ:
১. তসলিমা নাসরিনের প্রায় প্রফেটিক একটা কবিতা আছে। কবিতার নাম ‘ও মেয়ে শোন’। আরেকটা কবিতা আছে নাম ভুলে গেছি। একবার আমি তসলিমা নাসরিনের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলাম, সেখান আমাদের নাহিদ সুলতানা পড়েছিলেন কবিতাটা। সেখানেও অনেকটা এইরকমই কিছু কথা ছিল- একটি মেয়ে যদি নিগড়ে বাঁধা অন্ধকার থেকে বের হয়ে জীবনের মহাসড়কে বের হতে চায় তাইলে পুরুষশাসিত সমাজ থাকে বেশ্যা বলেই চিহ্নিত করবে। সেই কবিতাটাও আমাকে স্পর্শ করে, মুগ্ধ করে অবাক করে। আমি এখানে আপনাদের জন্যে ‘ও মেয়ে শোন’ কবিতাটা তুলে দিচ্ছি।
“তোমাকে বলেছে –আস্তে,
বলেছে –ধীরে.
বলেছে –কথা না,
বলেছে –চুপ।
বলেছে– বসে থাকো,
বলেছে– মাথা নোয়াও,
বলেছে — কাঁদো।
তুমি কি করবে জানো?
তুমি এখন উঠে দাঁড়াবে
পিঠটা টান টান করে, মাথাটা উঁচু করে দাঁড়াবে,
তুমি কথা বলবে, অনর্গল বলবে, যা ইচ্ছে তাই বলবে,
জোরে বলবে,
চিৎকার করে বলবে,
এমন চিৎকার করবে যেন ওরা দুহাতে ওদের কান চেপে রাখে।
ওরা তোমাকে বলবে, ছি ছি! বেহায়া বেশরম
শুনে তুমি হাসবে।
ওরা তোমাকে বলবে, তোর চরিত্রের ঠিক নেই,
শুনে তুমি জোরে হাসবে
বলবে তুই নষ্ট ভ্রষ্ট
তুমি আরও জোরে হাসবে
হাসি শুনে ওরা চেঁচিয়ে বলবে, তুই একটা বেশ্যা
তুমি কোমরে দুহাত রেখে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে বলবে, হ্যাঁ আমি বেশ্যা।
ওদের পিলে চমকে উঠবে। ওরা বিস্ফারিত চোখে তোমাকে দেখবে। ওরা পলকহীন তোমাকে
দেখবে। তুমি আরও কিছু বলো কি না শোনার জন্য কান পেতে থাকবে।
ওদের মধ্যে যারা পুরুষ তাদের বুক দুরু দুরু কাঁপবে,
ওদের মধ্যে যারা নারী তারা সবাই তোমার মত বেশ্যা হওয়ার স্বপ্ন দেখবে।”

(২)
এটা কি একরকম একটা অমোঘ বাণী ছিল না? চেয়ে দেখেন চারপাশে কী হচ্ছে? ওরা আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল নারীদেরকে এইরকম গালি দিচ্ছে। কেন? কেননা আমাদের নারীরা পিঠটা টানটান করে, মাথাটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলে। ওদের অধিকারের কথা বলে। জোরে বলে, চিৎকার করে বলে। একদম মিলিয়ে নিন, এখন ঐসব কুপের মণ্ডকগুলি আমাদের নারী অধিকার কর্মীদেরকে ঐ বলে গালি দিচ্ছে- বেশ্যা। আর কী অবাক কাণ্ড দেখেন, এইসব গালাগালিতে নারী অধিকার কর্মীরা একটু বিরক্ত হচ্ছে বটে, কিন্তু নিজের কাজটা থেকে বা নিজের পথটা থেকে বা নিজের মতটা থেকে একটি ইঞ্চিও সরে যাচ্ছে না।
ওরা যখন সংগ্রামের অগ্রভাগের নারীটিকে এইরূপ গালি দিচ্ছে, ঘরে ঘরে সহস্র মেয়ে তখন মনে মনে প্রস্তুত হয়- আমিও এই সংগ্রামে যোগ দিতে চাই, এইরকম অগ্রভাগে থাকতে চাই। তোরা আমাকে বেশ্যা বলে গালি দিবি- থুঃ, থোরাই পরোয়া করি তোদের।
(৩)
পুরুষতন্ত্রের সেপাই কতোগুলি দাঁড়িয়েছে। ওরা আমাদের নারীদেরকে সুস্বাদু একেকটা মাংসের চাকা ছাড়া আর কিছু মানবে না। আমাদের নারীরা যখন সবচেয়ে বড় বিদ্যালয়টিতে যাবে পাঠ গ্রহণ করতে, এই সেপাইগুলি তখন একাধারে গালি বর্ষাতে থাকবে। এই শয়তানী সেনাদের যে খবিস সেনাপতিটি, তার কিনা সর্বক্ষণ লালা ঝড়তে থাকে, সে তখন সবচেয়ে বড় বিদ্যালয়টিকে বলবে জেনার কারখানা।
কেননা ওদের চোখে যে ঠুলিটি আটকানো আছে, সেই ঠুলিতে কিনা নারী খোরমা কিংবা আখরোটের সমান- অথবা সুস্বাদু অন্য কোন মেওয়া। পুরুষ তাদেরকে খাবে। ঠিক যেরকম আমরা একজন আরেকজনকে মিষ্টি মেওয়া কিংবা অন্য কোন বস্তু উপহার দিই- ওদের চোখে নারীও এইরকম উপহার দেওয়া যায় এইরকম বস্তু। যেন আমি আমার কাকার জন্মদিনে বা আপনি আপনার অফিসের প্রধানের জন্মদিনে দুইটা নারী উপহার দিলাম- আমার কাকা বা আপনার দপ্তরে প্রধান তাদের মজা করে খাবে। অথবা তিনি চাইলে তিনিও ওদের মধ্যে একজনকে উপহার পাঠিয়ে দিবে অন্য কারও কাছে।
ওরা তো আঁতকে উঠবেই। এইরকম ভোগের মালগুলি নিজেদের মানুষ বানাতে চাইছে ওরা আঁতকে উঠবে না? আপনি যদি একদিন দেখেন যে আপনার খাবার টেবিলে বাটিতে রাখা রোস্ট কথা বলে উঠেছে, অথবা রসগোল্লাটি খাবেন বলে মুখে ঢুকিয়েছেন সে কান্না জুড়ে দিয়েছে- আপনি কি করবেন? এইসব সেপাইয়ের হয়েছে এই দশা। নারী কেন কথা বলবে নারী কেন হল্লা করবে, নারী কেন উচ্চৈঃস্বরে হাসবে নারী কেন সোজা হয়ে টানটান দাঁড়াবে- নারী কেন রাজপথে যাবে। ওরা আঁতকে আঁতকে ওঠে, নারী না আবার নিজেকে মানুষ মনে করে।
আপনি সেই কাজটিই করছেন গো। উচ্চকণ্ঠে কথা বলছেন, মেরুদণ্ড সোজা করে পিঠটান করে মাথা তুলেছেন আকাশপানে, হল্লা করছেন, রাজপথে নেমেছেন। আপনাকে ওরা বেশ্যা বলবে না? বলবেই তো।
(৪)
ছাড়ুন ওদেরকে। বেওকুফের দল বুঝতে পারে না যে ঐসব গালি দিয়ে মানুষকে কাবু করা যায় না। সেইসব অবরোধবাসিনীর জমানা গেছে কবে! ঐ সব সীতাদের দিন আর নেই যে ওরা অসতী বলে গালি দিবে আর সীতা শাবানার মতো কেঁদে বিছানায় ছুড়ে দিবেন নিজেকে অথবা প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে হেঁটে যাবেন সতীত্ব প্রমাণে। নারী কিনা জেনে গেছে ওরাও মানুষ আর আপনি তো সেই কথাটিই বলেন। গাধাগুলি জানে না যে এইসব গালিতে আপনাকে ভয় দেখানো যায় না। আপনি আর কি করবেন? ঐ তো কথাটা-
তুমি কি করবে জানো?
তুমি এখন উঠে দাঁড়াবে
পিঠটা টান টান করে, মাথাটা উঁচু করে দাঁড়াবে,
তুমি কথা বলবে, অনর্গল বলবে, যা ইচ্ছে তাই বলবে,
জোরে বলবে,
চিৎকার করে বলবে,
এমন চিৎকার করবে যেন ওরা দুহাতে ওদের কান চেপে রাখবে।