মেয়ে, হীরের আংটিটা তুমিই কিনে রাখো

শাহরিয়া দিনা:

আজকাল ফেইসবুকে প্রায়শই একটা ব্যাপার দেখি, কিছু শাড়ি, চুড়ি অথবা মেকাপের জিনিসপাতি’র ছবি দিয়ে মেয়েরা লিখে ‘ইস কেউ যদি কিনে দিত’! হয়তো মজা করেই এসব পোস্ট দেয়, তবুও দেখতে কেমন জানি আত্মসম্মানহীন লাগে। কিছু ব্যাপার মজা হলেও বলাটা ঠিক না। এমনিতেই কিছু মানুষের ধারণা, মেয়েরা টাকার দিওয়ানা। উদাহরণও আছে এমন, যে ছেলেটাকে কখনোই পাত্তা দিত না সে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে বা ভালো ক্যারিয়ারে পৌঁছেছে বলে তাকে বিয়ে করেছে। সেটা কেউ কেউ করতেই পারেন দোষের কিছু না। কারণ বিয়েটা তো একটা চুক্তি। যেহেতু চুক্তিবদ্ধ হবার মতো চুক্তিভঙ্গের ব্যাপারও এখানে আছে, তাই ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ইস্যুতে লাভ-ক্ষতি হিসেব করতেই পারেন।

কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ের বেলায় দেখা যায়, তারা টাকা কিংবা অলংকার নয় ভালোবাসা,সম্মান, কেয়ার চায়। প্রিয়জনের কাছ থেকে মুগ্ধ হতে চায়। যে তাকে চমকে দিবে একটুখানি আদরে, এক টুকরো ভালোবাসার সারপ্রাইজে। খুব দামী কিছু না তার জন্মদিনটা মনে রেখে ঠিক রাত ১২ টায় একটা এসএমএস অথবা একটা গোলাপে সে মুগ্ধ। দিনশেষে মেয়েটা ক্লান্ত মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে ‘মুখটা এতো বিষন্ন কেন’ জিজ্ঞেস করাতেই কেটে যাবে সব সব অন্ধকার। বিষন্ন মুখটাই হয়ে ওঠে সুখী প্রেয়সীর গর্বিত ঝলমলে চেহারা।

টাকার অভাবে কখনো সংসার ভাঙ্গে না, ভালোবাসার অভাবে সংসার ভাঙ্গে। অজুহাত হিসেবে দ্বার করায় টাকাকে। দুজনের মধ্যে প্রচণ্ডরকম ভালোবাসা থাকলে এক থালা ভাত ভাগ করে আধপেটা থাকা যায়, ছেঁড়া জামাটাও রিপু করে পরা যায়, কিন্তু ভালোবাসা না থাকলে এসবই বড় ইস্যু হয়। শূন্য থেকে শুরু করে হাতে হাত রেখে দুজন পরিশ্রম করে সফল হয়েছেন সুখে আছেন এমন অনেকেই আছেন। আবার সবই ছিল তবুও দুজন ছিল না একসাথে এমনও হয়।

বিয়েটা প্রত্যেকটা মানুষের কাছে একটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার। বিয়ের দিনটাও স্পেশাল। স্পেশাল হওয়াটাই স্বাভাবিক কারন, বিয়ের দিনটা একান্তই আমার। আমাকে ঘিরেই সব আয়োজন। এমন দিন তো মানুষের জীবনে প্রতিদিন আসেনা। প্রতিটি মেয়েরই লক্ষ্য থাকে এইদিনে যেন আমাকে রাজকুমারীর মতো সুন্দর লাগে। পার্লার বুকিং থেকে নেইলপালিশের ম্যাচিং সব নিয়েই সজাগ। এরমধ্যেই আসে কী গহনা হবে, কে কত ভরি দিবে সেই ব্যাপার। মেয়ের চাহিদা বা সামাজিকতার চাপে অনেক সময় মা-বাবা আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে যেয়েও খরচ করতে বাধ্য হয় বিয়েতে।

অমুক হীরের আংটি দিয়ে প্রপোজ করছে তোমাকে তা-ই দিতে হবে হবু বরের কাছে এমন আব্দার থাকে অনেকের। আবার বিয়েতে নাকফুলটা হীরের হয়নি কেন মন খারাপ থাকে। গয়নাটা আরেকটু ভারী হতে পারতো বলেও কথা ওঠে নিজ বাড়ি বা শ্বশুরবাড়িতে। উচ্চবিত্তের বিয়ের অনুষ্ঠান তো আজকাল ম্যারাথন রেসের মতো। সপ্তাহভর অনুষ্ঠান চলতেই থাকে। প্রচলিত হলুদ,বিয়ে, বৌভাতের সাথে মেহেদী, সংগীত,ব্রাইডাল শাওয়ার,ব্যাচেলর পার্টি আরও কত কি! এতসব আয়োজন সবার পক্ষে করা সম্ভব হয়না। আর্থিক সঙ্গতি অবশ্যই এখানে বড় ব্যাপার। প্রদর্শন প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমরা অনেক সময় বাধ্য করাই পরিবারকে।

আমাদের পরিবার বা সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ের জন্মের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বিয়ে নয় কখনো। বাবা-মা জন্ম দিয়েছেন। আদর-মমতায় পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করেছেন। এখন অন্য সংসারে যাওয়ার বা নিজের পরিবার গঠন করার সময়। এইসময় এসে কে কি দিল তার চাইতে চিন্তা করা প্রয়োজন আমি কাকে কতটা দিতে পেরেছি বা পারবো। নিজেকে শাড়ি-গহনায় মোরানো এক কলের পুতুল হিসেবে দেখতে চায়না সব মেয়ে। নিজের একটা ভালো ক্যারিয়ারে স্টাবলিশ দেখতে চায়। বৃদ্ধ বাবা-মা’য়ের দায়িত্ব নেবার মতো স্বাবলম্বী হতে চায়। গিফটের আশায় থাকেনা বরং প্রিয়জনদের গিফট দিয়ে প্রশান্তি পায়। বন্ধুর সাথে রেস্টুরেন্টে গেলে খাবার বিলটা আগ বাড়িতে দিতে চায়। ফ্লাট কিংবা গাড়িটা দুজনের সমান অংশীদারিত্বেই কিনতে চায়। এখানেই ঘুচে যায় ছেলেমেয়ে’র পার্থক্য। তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ।

বিয়েটা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয় বরং জীবনের একটা উপলক্ষ মাত্র। নিজের জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছে যখন মনে হবে, আমি একটি পরিবার গঠন করার মতো শারিরীক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে প্রস্তুত বিয়েটা তখনই হোক। কেউ দিবে সেই আশায় নয় বরং প্রিয় বলে নিজেই কিনে ফেলি দু’চারটে হীরের আংটি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.