জাকিয়া সুলতানা মুক্তা:
গতকাল বাসে করে গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। রাস্তায় নামাজের আযানের পরেই বাস থামাচ্ছে আর বিরতি নিয়ে মুসল্লী যাত্রীরা নামায পড়ার জন্য রাস্তার পাশের কোন মসজিদে যাচ্ছেন। ভালো কথা। পদ্মা পাড়ি দিয়ে আবার বাসে যখন উঠলাম তখন এশার নামাযের আযান দিয়েছে। বাসতো ছাড়ে না! কাহিনী কী? সুপারভাইজারের বক্তব্য~ “কয়েকজন নামায পড়তে গেছে, নামাযের উপর কোন কথা নাই। তাই বাস এখন ছাড়া যাবে না।”
আচমকা নামাযের উছিলা দেখিয়ে গোপালগঞ্জ টু ঢাকা রুটে বাসে বিরতি দেয়ার এই রীতি প্রায়ই হয়, এর সাথে তাই অভ্যস্ত। কেউ কিছু কখনো বলে না, আর আমিতো লৈঙ্গিক পরিচয়ে ‘নারী’! এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে তেড়েমেরে আসতে পারে, যেহেতু আমরা অতি সহিষ্ণু জাতি! তাই কখনোই কিছু বলি না। মাঝে মাঝে তাড়া থাকলেও, রাগ-ক্ষোভ-বিরক্তি নিজের মধ্যেই চেপে রাখি। ধর্মীয় আচার সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত, কেন তার জন্য সবাইকে কষ্ট দিতে হবে?
ওই বাসের সবাইতো মুসলিম নাও থাকতে পারেন, থাকলেও কারোর কোন ইমার্জেন্সি থাকতে পারে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর। সবার অনুমতি না নিয়ে, নিজেদের সিদ্ধান্তেই এরকম আচরণ সত্যিই আমার বিস্ময়কর লাগে। কেউ যদি অনুমতি নিয়ে বলেন যে, “নামাযের জন্য যাত্রাপথে বিরতি নেয়ার জন্য আপনারা যদি আমাদের মুসল্লী যাত্রীদের, সবাই একটু অনুমতি দিতেন; তাহলে আমরা সবাই আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।”
আমার মনে হয় না তাহলে কেউ অন্তত বিরক্ত হয়, সবাই আন্তরিকভাবেই তাহলে অনুমতি দিয়ে দিতে পারে। না দিলেও অন্তত মুসল্লীদের উপর লোকে বিরক্ত তো হয় না। কিন্তু না, সেই ভদ্রতা ওনারা করবেন কেন? এই দেশ নব্বই শতাংশ মুসলিমের দেশ, এখানে ওনাদের কর্তৃত্বই শেষ কথা। আমার কী? আমার কিছু বলার নাই। শুধু এতোটুকুই বলার এই দেশ বিশ্বের সেরা দুর্নীতিবাজদেরও জায়গা। এই ইবাদত বন্দেগী, এই দেশের মানুষের দুর্নীতি ঠেকাতে পারছে না; সেটাও গর্বের সাথে ওনারা উচ্চারণ করলে ভালো হতো। সেটা তো করবে না। যেমন গতকালও এরকম হলো।
সবসময় কিছু না বললেও, কী হলো গতকাল; ওই সময় আমি বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বললাম~ “অন্যান্য নামায আর এশার নামায কি এক? এশার নামাযের জন্য সময় তো দীর্ঘ। এই নামাযতো বাসায় ফিরে বা দুই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে বাস থেকে নেমেই কোন মসজিদ খুঁজে পড়লেও হয়। এখন কেন? আর এই যে ‘যানজটের ঢাকার শহর’, এখানে আপনাদের এই নানান অজুহাতে যাত্রাবিরতি দেয়া; এরজন্য রাত করে বাসায় ফিরতে গেলে কেউ কোন দুর্ঘটনার শিকার হলে, তার দায়িত্ব আপনারা কেউ নিবেন? এই শহর, এই দেশ তো এখন ‘ধর্ষণের মহোৎসবেরও দেশ’! দেখা গেলো~ গুলিস্তান থেকে নেমে বাড়ির পথ ধরতে গিয়ে কাউকে কোন অন্ধগলি পার হতে হচ্ছে, বেশি রাত হয়ে গেলে সেখানে কেউ কোন নিশ্চিত বিপদের মধ্যে পড়তেও পারেন। আপনাদের ইবাদতটা ব্যক্তিগত, পাশের মানুষগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বটাও আপনাদের ব্যক্তিগত হওয়ার প্রয়োজন আছে। সেসব নিয়ে কী ভাবেন না একবারও?”
আমার কথা শুনে দেখলাম অন্যান্য যাত্রীরাও তখন সুপারভাইজারকে ধমকাতে শুরু করলো। তারমানে সবাই বিরক্ত ছিলো। এরপর বের হলো আসল কথা। পরের বাসে লোকজন কম, তাই সেই বাসের যাত্রী একত্রে নেয়ার ধান্ধায় আসলে বারবার নামাযের দোহাই দিয়ে বাস থামাচ্ছিলো! সবাই তখন এও খেয়াল করলো, ঠিক সেই সময়ে আমাদের বাসের কোন যাত্রীই নামাযের জন্য বাস থেকে নামেনইনি! তার মানে এই দুর্নীতির দেশে ধর্মের নাম করে নিজেদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি জায়েজ করার প্রবণতা, কী আশ্চর্যজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাসের কেউ খেয়ালই করতে পারেনি সুপারভাইজার পুরোটা সময় এতোজন যাত্রীকে ধাপ্পা দিচ্ছিলো!
কী দেশ আমার? এই দেশে ধর্ষকেরা ধর্ষণশেষে ফেসবুকের লাইভে এসে অনুভূতি ব্যক্ত করবে নাতো, কোন দেশে করবে বলে আশা করেন?
যা হচ্ছে, এটাই হওয়ার কথা ছিলো। এটাই হবে, আরও ব্যাপক আকারেই হবে। এতে কোন সন্দেহ নাই। চলুক উন্নয়ন, ইটকাঠের উন্নয়ন। মানবিক উন্নয়নের চর্চা কবরে চলে গেছে, তার স্মরণও না থাকুক। এই দেশের মানুষ এসবই ডিজার্ভ করে।