“…আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!”

শীলা মোস্তাফা:

পুরনো গল্প, তবে শুধু গল্প নয়, এ ইতিহাস। ইতিহাস থেকে মানুষের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। বলা যাক সক্রেটিসের কথা। তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক। এথেন্সের পথে পথে ঘুরে ঘুরে তিনি এথেন্সবাসিদের প্রশ্ন করে বেড়াতেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আরও প্রশ্ন তৈরি হতো। এভাবেই আপেক্ষিক সত্যের সন্ধান করতে করতে জন্ম নেয় দর্শনবিদ্যার।

প্রথাগত চিন্তার বাইরে মানুষের ভাবনার প্রসার উন্মুত্ত করতে একটাই উপায়, নিজের অজ্ঞতাকে স্বীকার করে প্রশ্ন করা। আর তাঁর এই পাগলামোতে কারা বেশী আনন্দ পেতো, তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিত? এথেন্সের তরুণ সমাজ। তাঁর এই প্রশ্নের বানে জর্জরিত হয়ে জীবনকে, সমাজকে আবিষ্কার করার প্রণালিতে কোন পরিধি ছিল না। মানুষ, শাস্ত্র, রাষ্ট্র, সরকার, জীবন, সংসার, সমাজ, ধর্ম, ঈশ্বর, কিছুই বাদ ছিল না। তাকে ঘিরে জমে যেত তরুণ সমাজের জটলা। জানার, জানানোর আর জ্ঞানের উৎসরণ যেন এথেন্সের পথে পথে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আর এই নবজাগরণে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সরকার/রাষ্ট্রযন্ত্র “জাত গেল জাত গেল” বলে চিৎকার করে উঠলো। তরুণ সমাজকে অস্থির করার অপরাধে সক্রেটিসকে শাস্তি দেয়া হলো মৃত্যুদণ্ড।

শীলা মোস্তাফা

৩৯৯ বি সি তে যাঁর মৃত্যু হয়েছে, তাঁকে এই ২০২০ সালে এসেও আমরা আমরা স্মরণ করি পদে পদে।বাংলাদেশের সবার মুখে মুখে আজও তাঁর হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুর আগের মুহূর্তের বাণী “I to die, and you to live. Which of these two is better only God knows.” রাষ্ট্র সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কি তাকে সরিয়ে দিতে পেরেছে পৃথিবী থেকে? পারেনি! তিনি যে ছোট ছোট জানার উৎসুক প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন তা জ্বলছে আজও। কারণ তাকে ঘিরে থাকতো যারা সেই নবীনদের মাঝেই ছিল প্লেটো, যেনোফরম, এবং তাদের পথ অনুসারী অ্যারিস্তোতল, আলেক্সান্ডার এবং আরও অনেকে।

তিন শত সাতাশি বৎসর আগে জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিও ক্যাথেলিক চার্চের মনগড়া ধারণার বিরুদ্ধে বলেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হয়। এতো বড় কথা, ধর্মগ্রন্থের লেখাকে চ্যালেঞ্জ করা! ক্যাথলিক চার্চ ও ধর্মগ্রন্থের বিপরীতে তার অবস্থানের জন্য তার গায়ালগ বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাকে চিরদিনের জন্য গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তাঁর মৃত্যুর ৩০০ বছর পর প্রমাণিত হয় তিনি যা বলেছিলেন তাই সত্য। তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ, বৈজ্ঞানিক, সংখ্যাবিদ, সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি জ্ঞানের চর্চা করতেন এবং তা বিলিয়ে দেয়াই তাঁর আনন্দ। তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো সেই অধিকার। কারা কেড়ে নিয়েছে? ক্যাথলিক চার্চ, ধর্মযাজকরা। ধর্ম, যার ভিত্তি বিশ্বাসে, প্রমাণে নয়, তাদের কাছে সত্য শুধু একটি বই, যা কে কবে কীভাবে কেন লিখেছে প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু গ্যালিলিওর বিচার যদি হতো কোন আধুনিক আদালতে, জুড়ি বোর্ডে থাকতো আধুনিক চিন্তার, বিজ্ঞানমনস্ক, চিন্তাবিদ, যুক্তিবিদরা, তাহলে কী হতো! জ্ঞানের চর্চা হতো, হয়তো আমাদের তিনশত বছর অপেক্ষা করতে হতো না জানতে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না, পৃথিবী এবং এই পৃথিবীর মতো আরও অনেক গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এই মহান পিতার ঘরে জন্মেছিল দুই মেয়ে, যারা সমাজের ভয়ে অথবা পিতার শাপমোচনের জন্য ক্যাথলিক চার্চে নান হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন “All truths are easy to understand once they are discovered; the point is to discover them.” কে অনুসন্ধান করবে? আমাদের মুক্ত চিন্তা করা বারণ। আমাদের দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষকদের বিচার করে যারা অন্ধ জুজুবুড়িতে বিশ্বাস করে।

গ্যালিলিও হয়তো বেঁচেছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক সেই বেঁচে থাকা। আর সক্রেটিসকে মরে প্রমাণ করতে হয়েছে যে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে বাঁচায় কোন আনন্দ নেই। তাঁর আর একটি বাণী হয়তো কাউকে ভাবায়নি। “An unexamined life is not worth living.” কবিগুরু বলেছেন “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।…শিকল-দেবীর ওই যে পূজাবেদী চিরকাল কি রইবে খাড়া। পাগলামি তুই আয় রে দুয়ার ভেদি।”

কাজী নজরুল আরও পরিষ্কার করে বলেছেন,
“মানুষেরে ঘৃণা করি
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কিতাব সেই মানুষেরে মেরে।
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল! -মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।”

কবিগুরু, নজরুল মরে বেঁচে গেছেন, নয়তো এই মোদী হাসিনার যুগে এমনিতেই জেলে পচে মরতেন। যুগে যুগে ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ মানুষের মুক্ত চিন্তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও কেউ চিন্তার স্বাধীনতাকে বন্ধ করে রাখতে পারেনি, মুখে সুপার গ্লু লাগিয়ে দিলে, মানুষের ভাবনাকে কেউ বাঁধা দিতে পারবে না। আর তাঁর থেকেই জন্ম নেবে আর একজন লুথার কিং, নেলসন মেন্ডেলা, নেতাজী, কবিগুরু, নজরুল, লালন, বয়াতি শরিয়ত সরকার।

ধর্ম আর সাম্প্রদায়িকতার বাঁধন দিয়ে পদলেহকদের বাঁধা যাবে, মুক্তচিন্তার মানুষদের নয়। আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছি। আমি ওইসব তথাকথিত গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণা জানাচ্ছি যারা এর সমর্থন করছে।

প্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবির মৃত্যু: লোরকা স্মরণে জনসম্মুখে একজন কবির মৃত্যু দৃশ্য বর্ণনা করতে যেয়ে বলেছেন –

প্রথম গুলিটি তাঁর কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল-
যেমন যায়,
কবি নিঃশব্দে হাসলেন
দ্বিতীয় গুলিতেই তাঁর বুক ফুটো হয়ে গেল
তিনি অপরাজিতের মতন হাসলেন হা-হা শব্দে
তৃতীয় গুলি ভেদ করে গেল তাঁর কন্ঠ
কবি শান্তভাবে বললেন,
আমি মরবো না!
মিথ্যে কথা, কবিরা সব সময় সত্যদ্রষ্টা হয় না।
চতুর্থ গুলিতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তাঁর কপাল
পঞ্চম গুলিতে মড় মড় করে উঠলো কাঠের খুঁটি
ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে
জনতা ছুটে এলো কবির রক্ত গায়ে মাথায় মাখতে-
কবি কোনো উল্লাস-ধ্বনি বা হাহাকার কিছুই শুনতে পেলেন না
কবির রক্ত ঘিলু মজ্জা মাটিতে ছিট্‌কে পড়া মাত্রই
আকাশ থেকে বৃষ্টি নামলো দারুণ তোড়ে
শেষ নিশ্বাস পড়ার আগে কবির ঠোঁট একবার
নড়ে উঠলো কি উঠলো না
কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনি।
আসলে, কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
বলেছিলুম কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবে না!

#বয়াতি শরিয়ত সরকার গ্রেফতারের প্রতিবাদে

শীলা মোস্তাফা
এলিস ভিয়েও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.