মনোরঞ্জন ব্যাপারী ও বাতাসে বারুদের গন্ধ নিয়ে দু’চার কথা

লাবণী মণ্ডল:

মনোরঞ্জন ব্যাপারীর সাথে পরিচয় ঘটেছিল খুব পরিকল্পিতভাবে। পূর্ব থেকেই তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানা ছিল। যদিও তার কোনো বই বা লেখা তখনো পড়া হয়নি।

ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমেই তার সাথে সখ্যতা আরো গভীর হয়। যাই হোক, মাত্র একদিনের সাক্ষাৎ। বলা যায় সবোর্চ্চ আধাঘণ্টার। এরপর ওখান থেকেই ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’ বইটা কিনি এবং কিছুদিন পরই পড়া শুরু করি। নানা ঝুটঝামেলার কারণে বইটা শেষ করতে বেশ দেরি হয়েছে।
যাইহোক, লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারী নিজেকে চন্ডাল বলে পরিচয় দেন, এই পরিচয়টাতে তার খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হয়। যদিও নিজেকে ‘মানুষ’ হিসেবেই দাঁড় করাতে চাচ্ছেন।

তিনি তিন বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। রিফিউজি ক্যাম্পে থাকা শুরু হয়।। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে তিনি রাজনৈতিকভাবে জড়িয়ে পড়েন নকশাল আন্দোলনে। ১৯৭৪-৭৫ সালের প্রথম দিকে তিনি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। দুই বছর জেলে থাকেন। জেলে থাকাকালীন বন্ধুদের সাথে নানা গল্প-বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতেই লিখেন, ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী

নকশালদের জেল ভাঙার ঘটনা, জেলের অভিজ্ঞতা, জেলে শোনা সেইসব কাহিনী রয়েছে লেখকের এই বইটিতে। জেলে বসে তিনি নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া শেখেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় এসে রিকশা চালানো শুরু করেন এই সময় মহাশ্বেতা দেবীর সংস্পর্শে এসে তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়।

যতই পড়ছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। যদিও মাঝেমধ্যে খটকা লাগিয়েছি। রচনাশৈলী, শব্দচয়ন, বাক্যগঠনে মাঝেমধ্যে খটকা খেয়েছি। কিন্তু মূল ঘটনায় প্রবেশ করলেই তলিয়ে গিয়েছি অতল গহ্বরে।
রিভিউ মানে ফিরে দেখো। ‘ঘুরে ফিরে দেখা’। সুতরাং রিভিউ কাজটা ভয়ঙ্কর কষ্টসাধ্য। আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। তার চেষ্টা করছি না। কিন্তু বই পড়ে নিজের বোঝা এবং মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার অধিকার প্রত্যেক পাঠকেরই রয়েছে, দায়বোধও রয়েছে। এতে বলা যায়, নিজেকে ঘষে-মেজে তৈরির করার কাজটি আরো সহজসাধ্য হয়। সেই চিন্তা থেকেই এই দুঃসাহসিক কাজ মাঝেমধ্যেই করে থাকি।

একটি বই পাঠের পর স্রেফ পাঠক হিসেবে নয়, একজন বোধবুদ্ধিসম্পন্ন সমলোচক হিসেবে বইয়ের নামকরণ থেকে শুরু করে বইয়ের মোটিফ বা উপজীব্য, রচনারীতি, শব্দচয়ন, বিষয়ের সঙ্গে সমসাময়িকতার অন্বয় ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করাটাই রিভিউ। যেটা বোদ্ধা পাঠকদের কাজ। একজন দক্ষ ক্রিটিকের কাজ। যেটা এ সমাজে খুব কমই রয়েছে। এখানে রিভিউয়ের নামে যেটা হয় সেটা হলো, লেখকের সাথে আত্মিক সম্পরকটাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে প্রশংসার ফুলঝুরি।

বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক বিল অ্যাসেঞ্জোর মতে, বুক রিভিউ বইটি বর্ণনা করে, পর্যালোচনা করে এবং মূল্যায়ন করে। তার ভাষায় ‘ডেসক্রাইব, অ্যানালাইজ এন্ড ইভ্যালুয়েট’। এখানে বর্ণনা মানে সংক্ষিপ্তভাবে বইটির মূলভাব তুলে ধরা, যাতে রিভিউ পাঠক সহজেই উপজীব্য বুঝতে পারেন। ‘সিনপসিস’ বা সারাংশ বলেন কেউ কেউ।

যাই হোক, মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখা পড়ে তাকে বুঝছি তা নয়, তাকে বুঝেই লেখা পড়ছি। লেখা বুঝতে গেলে লেখককে বোঝাটা জরুরি। সাহিত্যিক তো কতজনই রয়েছে, কিন্তু ক’জনের শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি পজিটিভ। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সাথে শ্রেণিদৃষ্টিভঙ্গি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এই জায়গাটাই অক্ষুণ্ন রেখেছেন- মনোরঞ্জন ব্যাপারী। যারা প্রকৃতই লেখক, জনগণের লেখক, শ্রমিকশ্রেণির লেখক বা মনস্বী লেখক তারা কিন্তু নিজের শ্রেণির ঊর্ধ্বে উঠে পুরো সমাজকে নৈব্যর্ক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারেন। সমাজ পরিবর্তনে পজিটিভ ভূমিকা রাখেন। মনোরঞ্জন ব্যাপারী আপাতদৃষ্টিতে ঠিক সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন।

তিনি ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ বইয়ে লিখেছেন, ‘… যদিও পাগলাঘন্টি থেমে গেছে, তবুও এখনো সেপাইদের আক্রোশ কমেনি। তারা হন্যে হয়ে নম্বরে নম্বরে ঘুরছে কাকে কাকে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়। এখন আর শুধু নকশাল নয়, যে আসামি তেল দিতে অনীহা প্রকাশ করেছিল, সেই মওকায় তাকেও বানিয়ে দেওয়া যাচ্ছে প্রমাণ যখন হয়েই গেছে, নকশালদের সঙ্গে সাধারণ বন্দিদেরও যোগসাজশ আছে, আর বাধা কোথায়!…
…আকাশটা রক্তের রঙে রাঙিয়ে সূর্য পাটে বসেছে। আর কিছু সময় পরে অতলান্ত অন্ধকার গ্রাস করে নেবে চরাচর। সেই অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা হবে রক্তের দাগ। ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে ঢেকে দেওয়া হবে রক্তের ঘ্রাণ। মানুষের রক্তে বড়ো তীব্র গন্থ থাকে, আর থাকে অসংখ্য প্রাণবীজ। মাটির গর্ভে সেই রক্তের ফোঁটায় অঙ্কুতির হয় নতুন জীবন। নতুন উন্মাদনা। প্রতিশোধস্পৃহা। সর্বেোচ্চ প্রচেস্টা হবে কোথাও কোনো চিহ্ন যেন না থাকে।’

লেখক: লাবণী মণ্ডল

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম নিয়ে বই পড়তে পড়তে জেলজীবনের ইতিহাস অনেকটাই জেনেছি। ৬৩দিন অনশনে মৃত্যুর ইতিহাস জানি। নিজেদের দাবি আদায়ের কথা জানি। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জেলজীবনের ইতিহাস পড়তে পড়তে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারীদের ইতিহাস চেতনার আয়নায় জ্বলজ্বল করছিল। কালে কালে ইতিহাসগুলোর ঐতিহাসিক পটভূমিকই একই হয়। ঘটনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হয়। বর্তমানে চলছে সরাবিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন। আর এই সময়ে শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বটা অনেক বেশি। যে গুরুত্বকে অনুধাবন করেই মনোরঞ্জন ব্যাপারী লিখে যাচ্ছেন। আমাদের মতো তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্যের সব থেকে ওজনদার পুরস্কার, ভারতীয় মুদ্রায় ১৮ লক্ষ টাকার ডিএসসি প্রাইজের ২০১৯ সালের লংলিস্টে যে পনেরোটি উপন্যাস স্থান পেয়েছলি তার মধ্যে ছিল, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ‘বাতাসে বারুদের গন্ধ’র ইংরেজি অনুবাদ ‘দেয়ার্স গানপাউডার ইন দি এয়ার’। এটি অনুবাদ করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক অরুণাভ সিংহ।

এক সাক্ষাৎকারে মনোরঞ্জন ব্যাপারী বলেছিলেন, ‘পুরস্কারের আশায় আমি লিখি না। এই বইয়ে, ছ’য়ের দশকে দরিদ্র-নিপীড়িত মানুষদের জন্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের মরণপণ সংগ্রামকে তুলে ধরেছি।’ প্রসঙ্গত, ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’এর জন্য মনোরঞ্জন ২০১৪ সালে পান বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
সর্বসাকুল্যে, বইটি আরো অধিক বেশি পাঠকপ্রিয়তা পাক। ব্যাপক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাক। পাঠক তাদের চেতনাকে শান দিক, মনোরঞ্জন ব্যাপারীদের মতো লেখকদের পাশে দাঁড়াক, নিজের দায়বোধ থেকে, চিন্তাবোধ থেকে।
মনোরঞ্জন ব্যাপারীর কণ্ঠে তাল মিলিয়ে বলতে চাই, ‘নক্সালবাড়ি জিন্দাবাদ।

বি.দ্র :
মনোরঞ্জন ব্যাপারীর প্রকাশিত বইগুলি হলো:

ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন – ১ম পর্ব ও ২য় পর্ব
অন্য ভুবন
বৃত্তের শেষ পর্ব
জিজীবিষার গল্প
চণ্ডাল জীবন
বাতাসে বারুদের গন্ধ
অমানুষিক
গল্প সমগ্র – ১ম খণ্ড
গল্প সমগ্র – ২য় খণ্ড’
মতুয়া এক মুক্তি সেনা
মরণ সাগর পারে তোমরা অমর

১৮.০১.২০২০

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.