কৃষ্ণা দাস:
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীকে আমরা যেভাবে দেখতে ভালবাসি – ঘরকোণে লজ্জাবতী, সকল গৃহকর্মে সুচারু পারদর্শি।
বিবাহিত হলে স্বামী-সন্তান-শ্বশুর-শাশুড়ি সবার প্রতি সমান যত্নশীল এবং শ্বশুরবাড়ীর সবাইকে বিনি সূতোর মালার মতো এক সূতোয় গেঁথে রাখা, কখনও তার চাওয়া-পাওয়া ব্যক্ত না করা, ভালো থাকুক কিংবা না থাকুক সেটা কথা না, কথা হচ্ছে সব সময় মুখে হাসি ফুটিয়ে মুখ বুঁজে সব সহ্য করা।
আজকাল আরও ২/১ টা ডিমান্ড এর সাথে যুক্ত হয়েছে-
যেমন, শিক্ষিত, মডার্ন সাথে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই শিক্ষিত আর সুন্দরী বউয়ের ডিমান্ড অবশ্যই ঘরের শো কেইসে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার জন্য। যাতে করে লোকের কাছে বুক ফুলিয়ে বলতে পারা যায় ‘ সুন্দরী, শিক্ষিত, মডার্ন, তার ওপর শালীন বউ’।

এই সবে সত্যি অতটা কষ্ট লাগে না, কষ্টটা লাগে যখন আমরা নারীরাই আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা আধুনিকতার নাম করে, নারীবাদী ট্যাগ লাগিয়ে আমাদেরকেই আরও পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তখন সত্যিই অনেক কষ্ট লাগে, ঘাবড়ে যায়। নারীবাদ কী? স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা?
আমাদের আশেপাশে অনেক মডার্ন ড্রেসআপ মেয়ে দেখেতে পাই। যারা দেখতে দারুণ সুন্দর, স্মার্ট। কিন্তু যখন আপনি ওদের সাথে কথা বলবেন, দেখবেন এদের স্মার্টনেসের মূল কারণই হলো ছেলেদের বিশেষ করে, বড়লোকের ছেলেদের আকৃষ্ট করা।
বিয়েই যাদের প্রধান লক্ষ্য, অন্যের ঘাড়ে চেপে এরা পুরো পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখে। অনেকটা জীবন মানে জি বাংলার মতো জীবন এরা চায়। যে মেয়েগুলো কলেজ বা ভার্সিটি ডিঙ্গায় ভালো বিয়ে ‘বসার জন্য’ (অবশ্যই সবাই নয়)। হ্যাঁ আপনি বলতেই পারেন ড্রেস কোড ম্যানশন করে আমি যে খুব রেসিস্ট তার পরিচয়ই দিয়েছি। কিন্তু কী করবো বলুন, এরা যে শর্ট ড্রেস পরতে পারাটাকে আর দুটো ইংরেজি বুলি কপচানোকেই আধুনিকতা আর নারীবাদী তকমায় ফেলে! নিজেদের ইচ্ছে খুশিমতো নারীবাদকে ব্যবহার করে। একজন নারী হিসেবে তখন লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজি।
এক সময় আমি এদের দেখেই অনেক বেশি আশাবাদী হতাম, ভাবতাম এরা হয়তো মুক্ত চিন্তা করে। কিন্তু যখন দেখলাম, এরা কেবল খোলা পোশাকই পরে মনের দরজা-জানালা বন্ধ করে। এরাও কেবল বিয়ে করাটাকেই নারী জন্মের একমাত্র লক্ষ্য ভাবে, তখন ভীষণ হতাশ হই৷ যার যা খুশি পরুক। আমি কেবল চাই, মনটাকে একটু খুলে রেখে একটু আলো হাওয়া আসতে দিক। একটু নিজের জন্য ভাবুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক। আত্নসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করুক, কারণ যত তাড়াতাড়ি এরা ওসব আগাছা ঝড়িয়ে মুক্ত চিন্তা করতে পারবে, তত তাড়াতাড়িই তো নারীমুক্তি সম্ভব।
আমি মোটেও বিয়ের বিপক্ষে না। কিন্তু চাই মেয়েরা আগে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা শিখুক, নিজের জন্য বাঁচুক। বিয়ের মধ্যে খারাপ বা ভাল কি আছে সে ব্যাখ্যায় যাবো না, এটা করা না করা যার যার খুশি। তবে, একবিংশ শতাব্দীর একটা আধুনিক নারী যখন বিয়ে, শরীর ইত্যাদি কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সামনে এগুতে চায়, তখন আক্ষেপ হয়।
খারাপ লাগে যখন আমরা স্বামীর গোলাম হয়ে প্রতিদিন মুখ বুঁজে লাথি খাই। নিজের আত্মসম্মানটা ঠিক কিসে তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি।
এর জন্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা অবশ্যই দায়ী। তবে সে সাথে এটাও বলতে চাই, বিড়ালকে ভাঙ্গা বেড়া দেখালে বেড়াল তো টপকাবেই। কথা হচ্ছে, আপনি তো আর কোন অশিক্ষিত/মূখ্য নারী না। আপনি যদি মাইরকেও ভালবাসার অংশ ভাবেন, সন্দেহ করাকে ভাবেন টেইক কেয়ার, সেক্ষেতে তো আর অন্য কাউকে দোষ দেয়া যায় না। ভাল আর মন্দের পার্থক্যটুকু যদি করতে না পারেন তবে তো বলতেই হয়, ৪জি আর ৫জি এর যুগেও আপনার চিন্তাধারা এখনও মধ্যযুগেই পরে আছে৷
তাই কান্না মুছে এবার একটু ভাবুন, আপনার কি উচিত না নিজের জন্য বাঁচা? আপনি বাঁচতে শিখলে আপনার দেখাদেখি হয়তো আপনার বোন কিংবা মেয়েটাও বাঁচতে শিখে যাবে। এদের জন্যও তো আপনার কিছু দায়িত্ব আছে, না কি?
অনেক শিক্ষিত নারীরাই আবার নিজে নারী অধিকারের কথা বলে, ক্ষমতায়নের কথা বলে, কিন্তু এদেরই বোন, ননদ কিংবা ভাইয়ের বউরা কিংবা কাছের কেউ যখন অধিকারের কথা বলে, এরাই সবার আগে মুখ ভ্যাঙ্চায়, বিরোধ তৈরি করে। মূল কথা হচ্ছে, এরা ততক্ষণই অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত এদের স্বার্থে আঘাত না লাগে। মনে পড়ছে আমার এক বন্ধুর কথা, সে যখন বাবার বাড়িতে তার সম্পদের প্রাপ্য অংশটুকু বুঝে নিতে চায়, তখন তার মা হতে শুরু করে সব ভাইয়ের বউরা সবার আগে চেঁচিয়ে উঠে। অথচ ওদের ঘরে ২/১ জন আইনজীবীও ছিলেন।
কীভাবে সম্ভব? নারী অধিকার শুধু মুখে মুখে? অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হয়ে নারী মুক্তি কি আদৌ সম্ভব? অথচ এতো শুধু সম্পদের ভাগ বসানো তা তো নয়, এ যে একি সাথে প্রাপ্যতা, এ যে ন্যায্য দাবী। সমতাতো শুধু কাগজে কলমে আনলে চলবে না, নারী-পুরুষ সবাইকেই সমতাকে ধারণ করতে হবে।
এই প্রথাটা তো চালু করা জরুরি৷ প্রথা চালু করলেই তা নিয়মে পরিণত হবে। একটু সাহস করে এগিয়ে এসে ভাবতে হবে, আপনি ন্যায়ের জন্য লড়াই করছেন বলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাতেই লড়াইটা শিখে যাবে, ওদের রাস্তাটা একটু হলেও মসৃণ হবে।
অন্যের ঘাড়ে না চেপে নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা শিখতে হবে৷ নিজেকে সম্মান করে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে শেখা।
শেয়ার করুন: