নারী জাগরণের তারকা আলোময়ী নারী তাসমিমা হোসেন

নাজমুন নাহার:

আজকের দিনে এক মহীয়সী তারকা পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন, আজ আমি সেই নারীর কথা বলবো যিনি গত কয়েক যুগ ধরে এদেশের পিছিয়ে পড়া নারীদের কথা বলে আসছেন, অন্যদিকে সম্মানিত করে তুলে আনছেন আলোকিত নারীদেরকে। পাক্ষিক অনন্যার সম্পাদক, অনন্যার শীর্ষ দশ এর প্রবর্তক, নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় দৈনিকের প্রথম নারী সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। শুভ জন্মদিন আমাদের তারকা, তাসমিমা আপা।

এই জ্যোতির্ময়ী নারী আমাদের দেশের নারীদেরকে নানাভাবে আলো বিচ্ছুরণের জন্য বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছেন। বহু শতাব্দী থেকে পৃথিবীতে এমন মানুষের জন্ম আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের চক্রে চক্রে জমে থাকা কালো অশুভ ছায়াকে সরিয়ে দিয়ে আলোর উদয়ন ঘটিয়েছে। তাসমিমা হোসেন তেমনই একজন মানুষ যিনি তার নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে গত কয়েক যুগ ধরে নারী সমাজের নানান দিকগুলো তুলে ধরেছেন অপকট কন্ঠস্বরে।

তাসমিমা হোসেন

যুগে যুগে নারীরা উঠে এসেছে তাদের আপন শক্তিতেই। গত ২০০ বছরের বাংলাদেশের নারীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় শক্তি, সংগ্রাম, বুদ্ধি ও মেধায় বাংলাদেশের বহু নারী আপন গুণে মহিমাম্বিত করেছেন সমাজকে এবং দেশকে। তাসমিমা হোসেন তেমনই একজন। তিনি নিজেই শুধু আলোকিত হননি, অন্যদের সাথে নিয়ে পথ চলেছেন, এ দেশের পুরো নারী সমাজের চিত্রটাকে নানাভাবে তুলে এনেছেন। আশির দশকের পর থেকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এদেশের পিছিয়ে পড়া নারীদেরকে, আবার একইভাবে তুলে এনেছেন বহু আলোকিত নারীদেরকে। আমরা খুব ভাগ্যবান যে এ সময়কালে এমন একজন প্রতীকী নারীকে আমাদের মাঝে পেয়েছি।

৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাসমিমা হোসেনকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি আমার পড়ার টেবিলে অনন্যা ম্যাগাজিনের প্রথম পাতার সম্পাদকীয় কলামে। আমার তখন কিশোর বয়স, স্কুলের পরীক্ষা শেষ, ছোটবেলা থেকেই আমার পড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল, আর যে কোনো বই ম্যাগাজিনের মধ্যে খুব অল্প বয়স থেকেই খুব ভারি ভারি লেখা পড়ে ফেলতাম। একদিন অনন্যা ম্যাগাজিন উল্টাতেই তাসমিমা আপার হাসি হাসি মুখের মিষ্টি একটা ছবি, তার নিচে সমাজে নারীদের অবস্থানকে তুলে ধরার জন্য সম্পাদকীয় কলামে অসাধারণ প্রেরণাযুক্ত শব্দমালায় লেখা কলাম। কী শক্তিময়- প্রেরণাময় লেখা। আমি দারুণ উদ্বুদ্ধ হতাম।

আলোর বিচ্ছুরণ উঁকি দেওয়ার অনেকগুলো খোলা জানালা ছিল আমার মনে। শিশু বয়স থেকেই উনি আমার মনের মধ্যে একটা প্রতিচ্ছবির মত জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি তার দর্শন এবং চিন্তার মাধ্যমে এমন একটা প্লাটফর্ম দাঁড় করিয়েছেন- সে বয়স থেকেই সমাজের অনেক প্রশ্নবিদ্ধ লিঙ্গ বৈষম্য আমার চিন্তার জগৎকে প্রসারিত করেছে। আমি জানতাম না কখনো এই গুণী নারীর সাথে আমার সরাসরি দেখা হবে কিনা। কিন্তু তিনি আমার মনের মধ্যে শিশুকালের সেই পড়ার টেবিল থেকেই একটা বড় শ্রদ্ধার জায়গা দখল করেছেন।

আমি তখন আমার জীবনের এক স্বপ্নপূরণের তাড়ায় নীরবে ছুটে বেড়াচ্ছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ২০১৪ সালে আমি সুইডেন থেকে যুগোস্লাভিয়া বেল্টের দেশগুলি সফরের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। সার্বিয়া থেকে বসনিয়া বর্ডার ক্রস করে তখন পৌঁছেছিলাম বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনার বিশেগ্রাদ শহরে। তুর্কিশ অটোমানদের এবং যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধের চিহ্নিত স্থান সেই বিখ্যাত ড্রিনা রিভারের পাড়ে বসে কফি খেতে খেতে নেটে বাংলাদেশের খবরের কাগজে চোখ রেখে হঠাৎ করে আনন্দ আর বিস্ময়ে ভরে উঠলো মন- ‘ইত্তেফাকের নারী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হলেন তাসমিমা হোসেন’। খবর পড়তে পড়তেই মনের অজান্তে বলে উঠলাম, বাহ দারুণ খবর।

তারপর ২০১৮ সালের জুনে আমি তখন জিম্বাবুয়েতে ১০০তম দেশ ভ্রমণ শেষ করে বতসোয়ানা, মোজাম্বিক, লেসোথো, সোয়াজিল্যান্ড সফর শেষে জুলাই মাসে সাউথ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে রওনা হলাম, চলন্ত গাড়িতে বসেই ইন্টারনেটে খবরের পাতায় ভেসে আসলো বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় দৈনিকের প্রথম নারী সম্পাদক তাসমিমা হোসেন। আমি সাথে সাথেই হাতে তালি দিয়ে উঠলাম। তিনি তার যোগ্যতা বলে একটা বড় অবস্থানে নিজেকে তুলে এনেছেন।

আফ্রিকা থেকে সুইডেন ফিরে আমি একবার গুগল ইঞ্জিনে সার্চ করে দেখি ৩ জুন ইত্তেফাকের ঐতিহ্য সাধু ভাষায় আমাকে নিয়ে লেখা হয়েছিল ইত্তেফাক এডিটোরিয়াল। আমার ১০০ দেশ ভ্রমণের রেকর্ডকে সাধুবাদ জানানো হয়েছিল। তারপর একদিন ওনার সাথে ফোনে প্রথম কথা বলার সুযোগ হয়। আমি কিছু বলার আগেই ‘হ্যালো’ বলেই ওপার থেকে প্রথমে তাসমিমা আপা বলছেন, ‘হোয়াটএবার ইউ আর ডুইং ইটস সো গ্রেট’। তার কনভারসেশনের প্রথম লাইনই আমাকে দারুণ উৎসাহিত করেছিল। এই প্রথম তার কথা শুনলাম। ফোনটা রেখে ভাবলাম কী সাংঘাতিক ইন্সপায়ারিং উইমেন তিনি!

অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার গ্রহণের দিন লেখক

তারপর থেকে চিত্রপট ভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে। আমি জানতাম না যে আমি তার ‘অনন্যা’ হতে যাচ্ছি। তখন আমি পশ্চিম আফ্রিকা সফরে মৌরিতানিয়া ডেজার্ট থেকে ফিরে নোয়াকচট শহরে অবস্থান করছি। হঠাৎ করে আমার একটা ফোন এসেছিল, বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিশ্ব ভ্রমণের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাকে অনন্যার জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে। আমাকে তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য ডাকা হলো।

২০১৯ এর জানুয়ারির শেষের দিকে আমি দেশে ফিরি ১২৫তম দেশের রেকর্ড নিয়ে। ছোটবেলায় যে মানুষটিকে আমি পড়ার টেবিলে আবিষ্কার করেছিলাম- ২০১৯ এর ৩০ জানুয়ারির সকাল এগারোটায় সেই আলোময়ী নারী তাসমিমা হোসেনের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় তার অফিসে।

কী অসাধারণ একজন মানুষ তিনি! জ্ঞান, আভিজাত্য, রুচিশীলতায় তিনি যেমনি ভরপুর তেমনি খুব সাবলীল, সুন্দর, হাসি খুশি প্রাণোচ্ছল একজন মানুষ। বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করেও তিনি বৈষম্য, নির্যাতন ও নানা বাধাবিঘ্নের বিরুদ্ধে নারীর মানবিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সক্ষমতা ও অগ্রগতিকে তুলে এনেছেন।

১৯৯৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মানিত করেছে ২৫০ জন কৃতী নারীকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন তাসমিমা হোসেনের এই মহৎ কাজ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নারীদের চলার পথকে আরো উদ্বুদ্ধ করবে। তার কাজের মাঝে যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন তিনি। সুস্থ ও দীর্ঘজীবী হোক তার জীবন।

নাজমুন নাহার, বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্বজয়ী

শেয়ার করুন: