যেভাবে দুশ্চিন্তার দৈত্যকে সামলাবেন!

ফারজানা সুরভি:

আমার এংজাইটি আছে। খুব ছোট-খাটো ব্যাপার নিয়ে আমি টেনশন শুরু করে দেই। এই সদা উদ্বিগ্ন থাকার সমস্যাটা অনেকের ক্ষেত্রেই খুব জটিল আকার ধারণ করে। মাঝে মাঝে এই মানসিক এংজাইটির প্রভাব মস্তিষ্ক থেকে শরীরে বিস্তার ঘটায়। যেমন, শ্বাস নিতে হালকা কষ্ট হওয়া, মাথা ব্যথা করা, ঘাড় দপদপ করা, বুকে ব্যথা করা ইত্যাদি।

আগে আমি যখন উদ্বিগ্ন থাকতাম, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ফোন করে ক্রমাগত জ্বালাতাম। একই টেনশনের কথা বারবার বলতে বলতে আশেপাশের মানুষদের বিরক্ত করতাম। কিন্তু তাতেও মস্তিষ্ক শান্ত হতো না! তো গত কয়েক মাস ধরে আমি বেশ কিছু কোপিং স্ট্র্যাটেজি ফলো করছি, এই সদা উদ্বিগ্ন থাকার সমস্যাটাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার জন্য। মনে হলো- ফেসবুকে কোপিং স্ট্র্যাটেজিগুলো শেয়ার করি, যদি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পড়ে কেউ উপকার পান!

এক) আমার থেরাপিস্ট আমাকে বলেছিল যে, এংজাইটিতে আক্রান্ত হলে শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে কাজ লাগাতে হয়। তাহলে উত্তেজিত স্নায়ু আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়। সেটা বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখি যে টেনশনের সময় এতো কথা মাথাতেই থাকে না! যাই হউক, আমি এই কোপিং স্ট্র্যাটেজি বাস্তবে প্রয়োগের আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ঠিক তখন আমার বান্ধবী কথার সাথে কথা বলতে বলতে ওর কাছ থেকে আমি একটা চমৎকার বুদ্ধি পাই!

আমি প্রথমেই একটি কমফোর্ট বাক্স তৈরি করি। এটা আমার বিছানার পাশেই থাকে, যেন কোন কিছু নিয়ে টেনশন হলে হাত বাড়ালেই আমি বাক্সটা ধরতে পারি। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে ঘ্রাণ। আমি বাক্সে একটি ছোট পারফিউমের বোতল রেখেছি। এরপরে দর্শন ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগানোর জন্য রেখেছি একটি প্রিয় বই। রোয়াল্ড ডালের “দ্য উইচেস” একটা বাচ্চাদের বই। এই বইটা পড়লেই আমি একটা কমফোর্ট অনুভব করি। স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগানোর জন্য বাক্সে আমার প্রিয় একটা নরম টেডি বিয়ার আছে। তার নাম ‘কুটুশ’। টেনশন হলে কুটুশের নরম ফারে হাত বুলাই। স্বাদ ইন্দ্রিয়ের জন্য বাক্সে রেখেছি তিনটা চকলেট। আর শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের জন্য চিন্তা করেছি একটা ছোট্ট ঘণ্টা রাখবো বাক্সে। যা আস্তে করে ধাক্কা দিলেই, একটা মিষ্টি টুং টাং আওয়াজ হবে। তো এংজাইটিতে আক্রান্ত হলেই আমি এখন হাত বাড়িয়ে কমফোর্ট বাক্স থেকে আমার প্রিয় এই পাঁচটা জিনিস বের করি। আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগাই। আমার জন্য এই পদ্ধতি কাজ করছে।

দুই) আমার একজন বন্ধু রমা বলেছিল, প্যানিক এটাক হলে সাথে সাথে একটা ব্রাউন ব্যাগ নিতে হয়। তারপরে ব্রাউন ব্যাগে মাথা ঢুকিয়ে লম্বা লম্বা করে শ্বাস নিতে হয়। এটা স্নায়ুকে শান্ত করে। আমি এখন বিছানার পাশে তাই একটি ব্রাউন ব্যাগ রাখি।

তিন) আমার থেরাপিস্ট আমাকে বলেছিলো যে, এংজাইটি সবসময়ে শুরু হয় খুব ছোট একটা ব্যাপার দিয়ে। তারপরে চক্রাকারে চলতে থাকে। তো এই চক্রটাকে থামানোর জন্য নিজেকে একটা কথা বলতে হয়, যেটা বললে হয়তো আমি টেনশনটা যে অবস্থাতে আছে- ঠিক সেখানেই একটা পজ দিতে পারবো! এই কথাটা কী হবে, সেটা আপনার উপরে নির্ভর করে। এমপাওয়ারিং ধরনের কোন কথা হতে পারে। তো থেরাপিস্ট আমাকে বললো, আশেপাশের দেয়ালে বা কোথাও আমাকে আমার পছন্দের এই এম্পাওয়ারিং কথাটা লিখতে হবে। তারপরে এংজাইটি শুরু হলেই সেই লেখাটার দিকে তাকিয়ে চিন্তার চক্রকে থামাতে হবে।

আমার বাসায় তিনটা হোয়াইট বোর্ড আছে। তার একটাতে আমি লিখে রেখেছি- “ফাক ইট অল! আই ডোন্ট গিভ আ শিট”! তো, আমার জন্য এটাই এমপাওয়ারিং কথা। আমি যখন বুঝি যে- নিজের দুশ্চিন্তার জালে আমি নিজেই আটকে যাচ্ছি, তখন আমি এই হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকাই। তাকিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে বলি- “ফাক ইট অল”! এটা আমার দুঃশ্চিন্তা তাৎক্ষণিকভাবে থামাতে সাহায্য করে।

চার) ক্যাফেইন ইনটেকের ব্যাপারে খুব খুব খুব সাবধান! মাঝে মাঝেই ঘুম ঠেকানোর জন্য আমি অতিরিক্ত কফি খাই। যেটা হয় যে, কফির ইনটেক বেশি হলে সেটা আপনার এংজাইটিকে আরো তীব্র করে তুলবে। কফি তাই পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।

পাঁচ) বছর দুয়েক আগে আমি মেডিটেশন করতাম মাঝে মাঝে। ইউটিউবে পাঁচ মিনিটের বিভিন্ন মেডিটেশন আছে। যেটা খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে উদ্বিগ্ন মস্তিষ্ককে একটা পজ দিতে সাহায্য করে। মেডিটেশন আমার জন্য খুব একটা ভালো কাজ করে না। কিন্তু অনেকেই এতে চমৎকার ফল পান বলে শুনেছি।

ছয়) ইউটিউবে স্নায়ু ঠাণ্ডা করার মতো কিছু মিউজিক আছে। সেটা শুনতে পারেন।

সাত) অনেকের ক্ষেত্রেই প্রার্থনা বা একটি সুরা বারবার আবৃত্তি করলে কাজে দেয়। আমি পরীক্ষার সময়ে খুব টেনশনে থাকি। তখন ক্রমাগত আমি “রাব্বি জিদনি ইলমা” আবৃত্তি করতে থাকি।

আট) মাঝে মাঝে কিছুই করতে ইচ্ছা না করলে আমি ইউটিউবে একটা অডিও বুক ছেড়ে দেই। আমার এ ব্যাপারে পছন্দের বই হচ্ছে “দ্য আলকেমিস্ট”। অসম্ভব অনুপ্রেরণামূলক একটি উপন্যাস। আমি চুপচাপ বসে বসে এই অডিও বইটি শুনতে থাকি।

নয়) ভুলেও এংজাইটিতে থাকার সময়ে আমি ফেসবুকে স্ক্রল করি না। আমার কাছে মনে হয় স্ক্রলিং করার সময়ে লেখার ক্রমাগত ওঠানামা আমার মাথা ব্যথা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

দশ) পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসি। বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে গ্লাসের পানি একটু একটু করে শেষ করি।

সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে, সমস্যাকে শনাক্ত করা। আপনি যখন সমস্যাকে অস্বীকার করবেন না, তখনই সমস্যা সমাধানের পথে আপনি অনেক দূর এগিয়ে যাবেন। আমাদের জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই কথাটা কার্যকরি।

বাংলাদেশীদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে যে, গা ঝাড়া দিয়ে স্ট্রেস- এংজাইটি- ডিপ্রেশনকে আমরা অস্বীকার করে ফেলি। বলি, “ধুর! ধুর! মন শক্ত করলেই হবে!” কিংবা “আরে! দুই বেলা খাইতে পাচ্ছো, মাথার উপরে ছাদ আছে, তোমার আবার কীসের চিন্তা”!

এই এপ্রোচটা ভুল। এটার মাধ্যমে সমস্যাকে স্বীকার না করে ধামাচাপা দেয়া হয়। আর এই ধামাচাপা দিতে দিতে সমস্যা একদিন বিশাল আকার ধারণ করে। সমস্যা অস্বীকার করার প্রক্রিয়াতে অনেক সময় আমরা সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে আজেবাজে কথা বলে ফেলি। তারপরে অপরাধবোধে ভুগি! তার চেয়ে সমস্যাকে শনাক্ত করুন, স্বীকার করুন, সেটা নিয়ে ভাবুন।

ভাবনা একটা অভ্যাসের মতো। সম্ভব হলে একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলেন। তারা প্রফেশনাল। তাই তারা বিভিন্ন কোপিং স্ট্র্যাটেজি সাজেস্ট করার মাধ্যমে আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। সেটা যদি সম্ভব না হয়, গুগল করুন কীভাবে দুঃশ্চিন্তার জাল কেটে দেয়া যায়! তবু সমস্যাকে অস্বীকার করবেন না!

আমাদের দেশের পুরুষদের মধ্যে সব সমস্যাকে অস্বীকার করে নিজেকে শক্ত প্রমাণের একটা প্রবণতা আছে। এটা ভয়ংকর! কেননা তারা বুকের মধ্যে তাদের অনিরাপত্তাবোধ, দুঃশ্চিন্তা, হতাশা লুকিয়ে রাখতে রাখতে হয় হিংস্র হয়ে যায় দিনে দিনে। না হয় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। না হয় মনে মনে কষ্ট পেতে থাকে। নিজেকে শক্ত দেখানোটা জরুরী না! নিজের ভয়ের মুখোমুখি হয়ে তার সাথে লড়াই করাটা জরুরী!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.