এম্পাওয়ারমেন্ট, লজ্জা আর রেপ

আনন্দময়ী মজুমদার:

বিষয়টা নিয়ে বলা খুবই কঠিন, তাই এতোদিন কিছু লিখতে ইচ্ছে করেনি। আমি এক্সপার্টের জায়গা থেকে নিশ্চয়ই বলতে পারি না। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে শঙ্কিত হই, সবার মতো প্রতিদিন রেপের ঘটনা শুনে। আর আলোচনা শুনে।

বেশ কিছুদিন মনোস্তত্ব, সমাজবিজ্ঞান নিয়ে যা ঘাঁটাঘাঁটি করছি, কোর্স নিচ্ছি, বই পড়ছি তার ফলস্বরূপ একটা হাফ-বেকড ব্যাপার হতে পারে নিচের লেখা। যা হোক, আলোচনার সূত্রপাত আর কী!

আজকেই পড়ছিলাম, চিলিতে রেপের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আর পুলিশকে দায়ী করে মেয়েদের প্রতিবাদ। প্রতিবাদ চলছে প্রতিনিয়ত। এর ফলে ডিবেট তৈরি হয়েছে। ডিবেটের কাজ প্রশ্ন তোলা, আর প্রশ্ন না তুললে কিছু পাল্টায় না। পথ বের হয়ে আসে না। আর ছোট ছোট প্রশ্ন থেকে সরল বা গভীর প্রশ্ন দেখা দেয়।

এখানে সেইরকম একটা সরল প্রশ্ন থাকছে। প্রশ্নটা হলো, রেপ যারা করে তাদের কী ধরনের সাইকোলজি, আর কীভাবে এ ধরনের সাইকোলজি তৈরি হয়?

আমরা রাষ্ট্রের কাছে রেপিস্টদের দ্রুত বিচার আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। আমাদের আশা রেপিস্টদের এমন শাস্তি দিলে রেপ থেমে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক শওকত হোসাইনের লেখা পড়ে বুঝতে পারলাম, রেপিস্টদের শাস্তি দিলেই রেপিস্টদের অপরাধ প্রবণতা চলে যাবে না। অপরাধ থেমে যাবে না। লেখক একজন criminal psychologist, বিচারক আর ম্যাজিস্ট্রেট। লেখাটা কয়েক হাজার হয়তো শেয়ার হয়েছে ফেসবুকে এর মধ্যে। অন্য পোর্টালেও এসেছে।

মূলত লেখক বলছেন, রেপিস্টদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে।

আনন্দময়ী মজুমদার

তিনি বলছেন, রেপিস্টদের আত্মমর্যাদার ঘর ধ্বস্ত থাকে। নিজেদের শক্তিশালী প্রতিপন্ন করার জন্য রেপ করে। ১০০ ভাগ ক্ষেত্রে এর মানে দাঁড়ায়, এই ব্যাপারটা ভিক্টিমের বিষয় না। এটা সম্পূর্ণ রেপিস্টের মনস্তাত্ত্বিক এক ধরনের পাওয়ার ক্রাইসিস, একটা সুনির্দিষ্ট dysfunctionality, যা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

এই কথাটা আমার কাছে নতুন, আমার ধারণা বেশির ভাগ পাঠকের কাছে নতুন। লেখক বলছেন রেপিস্টরা নিজেদের দুর্বল মনে করার মধ্যে নিহিত আছে অপরাধের বীজ। এটা justification না, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।

এখন কথা হলো, নিজেকে এতোটা দুর্বল, এতটা শূন্য মনে করবে কেন কেউ? করে কেন? এটা কি জন্ম থেকে পাওয়া, নাকি সমাজ থেকে পাওয়া একটা বোধ?

সমাজবিজ্ঞানী আর মনোবিজ্ঞানীদের কাছে শিখেছি, গ্লানি থেকে আসা লজ্জা আমরা জন্মমুহূর্তে পাই না। এই বোধ আমরা বড়ো হতে হতে পাই। আশেপাশে আমাদের আপনজনদের কাছেই অনেক সময় পাই। অথবা শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু, পরিবার ইত্যাদির কাছে পাই। নাজুক মুহূর্তে এই বোধ আমরা আহরণ করি আর অনেকেই শিক্ষার অভাবে এটা ঠিকমতো প্রসেস করতে পারি না। অথচ লজ্জা আমাদের আত্মমর্যাদা ভেঙে দিতে পারে। আমাদের জীবন বিপন্ন করতে পারে।

কেউ কেউ এই লজ্জার বোধকে চ্যালেঞ্জ করে বেরিয়ে আসতে পারি। কেউ কেউ পারি না। লজ্জার ঘেরাটোপে ডুবে যাই। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই লজ্জা আমাদের কে দেয়? কেন দেয়? বুঝে দেয় না না বুঝে দেয়? কোথায় নিয়ে যায় আমাদের এই লজ্জার বোধ। কতোটা নিচে? পরিত্রাণ কীভাবে হবে?

ব্রেনে ব্রাউন নামের একজন সমাজবিজ্ঞানী আছেন। আমি দেখছি রেপ নিয়ে লজ্জা নিয়ে কিছু বলতে গেলেও লেখকরা কখনো তাকেই কোট করেন। লজ্জা নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন আর টেড টকে এসেছেন।

ব্রেনে বলেন, লজ্জার ভাষা ব্যক্তিগত আক্রমণের মতো। আপনি বলছেন উক্ত লোক শক্তিহীন, অপদার্থ, গুড ফর নাথিং, কোনদিক থেকে অপর মানুষের চেয়ে কিছু কম। ফলে লোকটা যদি বেসিক্যালি একটা নাজুক লোক হয়, বা নাবালক হয়, সে বিশ্বাস করতে শুরু করবে আপনি যা বলছেন সে তাই।

যতদিন সে লজ্জাকে কারো সামনে অকপটে স্বীকার না করবে, ততদিন সেই লজ্জার ক্ষত তার মধ্যে থেকে যাবে।

এভাবে অনেক সন্তানের আত্মমর্যাদা অভিভাবকরাই নষ্ট করে দেয়। সেটা যদিও অচেতনভাবেই করে। ছেলেরা বিশেষ করে লজ্জার ক্ষত প্রকাশ করতে পারে না। শেয়ার করতে পারে না। ছেলেদের দুর্বল বলে মনে হওয়া সমাজে নিষেধ আছে। সেইজন্য ছেলেরা চোখের জল ফেলতে পারে না। এটাকে দুর্বলতা মনে করে। আরোপিত একটা সামাজিক বোধ।

ছোটবেলায়/নাজুক অবস্থায় যাদের শারীরিক মানসিক নির্যাতন করা হয় তাদের মধ্যেও লজ্জা শিকড় গাঁড়ে প্রায় নিশ্চিতভাবে। সকলেই রেপিস্ট হয় না। কিন্তু রেপিস্টরা যে লজ্জার শিকার সেটা ঠিক, কারণ সেভাবেই পাওয়ার ক্রাইসিস তৈরি হয়।

সুতরাং আসল কাজ লজ্জার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সচেতনতা প্রয়োগ করা। ব্যক্তিগতভাবে কাউকে ছোটো না করা। কাজটা যে খুবই কঠিন সন্দেহ নেই। আসলে ব্রেনের কাজ না জানলে এসব জানা হতো না।

ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের যে কোন ত্রুটিকে কাজের ত্রুটি হিসেবে তুলে ধরা আর লজ্জা না দিয়ে, জবাবদিহিতা চাওয়া হলো আদর্শ প্যারেন্টিং। যে কেউ ভালো কাজ চাইলেই করতে পারে, সেরকম প্রত্যয় আর বিকল্প দিতে হয়। এতে তাকে পারসোনালি ছোট করা হলো না। কিন্তু জবাবদিহিতা চাওয়া হলো, সঠিক কাজটা করার সুযোগ দেওয়া হলো। এভাবে ভুল করে ঠিকটা শেখা যায় এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা সে পায়।

একে বলা হয় গ্রোথ মাইন্ডসেট। নিউরোপ্লাস্টিসিটি নিয়ে এখন যে কাজ হচ্ছে তাতে জানা যায় এটাই শিক্ষার জন্য আদর্শ পথ। আপনি যে কোনো সময় চাইলে নতুন দিশা শিখতে পারেন, অভ্যেস আর সংস্কার পাল্টে নিতে পারেন। এটা এক ধরনের এম্পাওয়ারমেন্টের হাতিয়ার।

যে এম্পাওয়ারড, অন্যের মতামতের ওপর তাদের আত্মপ্রত্যয় নির্ভর করে না। বংশমর্যাদা, প্রতিভা, কীর্তি, শক্তিমানতা বা জাগতিক প্রাপ্তির ওপর করে না। ব্রেনে আমাদের শেখান কী করে আত্মমর্যাদাকে অন্যের মতামতের দাসত্ব থেকে স্বাধীন করতে হবে।

মানুষ হিসেবে জন্মানোর সুবাদে, আমাদের সকলের একটা প্রাণের মর্যাদা আছে। এই মর্যাদা কাজে, লেখায়, ইমোশনাল ডিবেটের সময়, আর বিশেষ করে বিপর্যয়ের সময় বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আমরা লজ্জার সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে পারব।

এই প্রসঙ্গে অলকানন্দ রায় নামের একজন সমাজ-সংস্কারক আর নৃত্যশিল্পীর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বিশ্বাস করেন, কেউ মূলত অপরাধী না। তারা অপরাধ করে। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে নিলে তারা ভালো কাজ করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। তিনি এইভাবে বহু সিরিয়াল কিলার, রেপিস্ট ইত্যাদি, নানা রকম অপরাধ জগতের মানুষকে একা হাতে ফিরিয়ে এনেছেন স্বচ্ছতার আর আলোর পথে। তাঁর হাতে ছিল নৃত্য, আর ছিল এক বুকভর্তি ভালোবাসা আর আত্মপ্রত্যয়। তাঁর আত্মপ্রত্যয় অপরাধ জগতের সকলকে স্পর্শ করে আলো জ্বালিয়েছিল। এসব সত্যি ঘটনা।

এটাও এক ধরনের এম্পাওয়ারমেন্ট।

যেহেতু রেপ পাওয়ার ক্রাইসিস থেকে আসে, সুতরাং আমরা যদি যুক্তি দিয়ে ভাবি, এই ক্রাইসিসের অবসান কীভাবে হবে? তাহলে হয়তো বুঝতে পারি, ছেলেদের (সকলের) শিক্ষা আর যাপনে লাগবে shame থেকে মুক্তি — এম্পাওয়ারমেন্ট, আত্মপ্রত্যয়, আত্মমর্যাদার পূর্বশর্ত।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.