অভিযুক্ত মজনু এবং আমাদের ফেসবুক ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ

প্রমা ইসরাত:

ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তের নাম মজনু। এবং তাকে দেখে অনেক মানুষ ধর্ষক হিসেবে মেনে নিতে পারছে না। চারিদিকে ছিছিকার হাহাকার এর পাশাপাশি একটা হাসির রোলও পড়ে গিয়েছে।

তো মজনু মিয়া ধরা পড়েছে। এবং অনেকেই ৭০% নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হয়ে গেছেন। মানে তারা দ্বিমত করছেন, আস্থা রাখছেন দ্বিতীয় বিদ্যায়, প্রশ্নের পাথরে বিক্ষত হচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবাদ করছেন, বুদ্ধির নখে শান না দিয়ে।

মজনু’র সামনে দুইটা দাঁত নাই। দেখতে রোগা পটকা, নেশাখোর হিরুঞ্চি। সে একটা মেয়েকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘন্টা ভরে ধর্ষণ করেছে, এই ব্যপারটা মেনে নিতে পারছে না, ফেসবুক সমাজ।
স্বাভাবিক এই দেশে এতগুলো রেইপ হয়ে গেলো, কিছু রেইপের ক্ষেত্রে, আমরা তো জানি যে, রেপিস্ট ক্ষমতাশালী থাকে, অর্থ বিত্ত থাকে, ঘুষ টুষ দিয়ে, পালিয়ে যায়। আবার অনেকেই ওই নিজের বদলে অন্য কাওকে অপরাধী সাজিয়ে আয়নাবাজি-আয়নাবাজি খেলতে থাকে।
তো এই ক্ষেত্রে, দ্বিমত হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
মানে মজনু যদি ছোট বাচ্চা বা পশু-পাখি রেইপ করতো, তাহলে একটা স্বান্তনা পাওয়া যেতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো, একটা বিশ্ববিধ্যালয়ের একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে রেইপ করার মতো গুর্দা তার থাকার কথাটা একদমই হজম করা যাচ্ছে না।

মানে যমেরও অরুচি টাইপ একটা চেহারার লোক কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েকে রেইপ করলো!!
আমাদের দেশে “মেনে নে মা মেনে নে” বলে একটা দল আছে, আরেকটি দল আছে, এরা “মানি না মানবো না” দল। এরা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড, ছেলের বউ, ভাইয়ের বউ, বউ এর ভাই, ছেলের ঘরের নাতিন, খারাপ রেজাল্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়া, নির্বাচন, ক্রিকেটে হেরে যাওয়া, পরকীয়া প্রেম, ডিভোর্স, বাচ্চা না হওয়া, প্রেমে ধোঁকা খাওয়া, কিছুই মেনে নিতে পারে না।
আবার এই “মেনে নে মা মেনে নে” দল, এবং “মানিনা মানবো না” দল একে অপরকে মেনে নিতে পারে না।

যাই হোক।

আমি ফেসবুকে অনেকগুলো পোস্ট কমেন্ট পড়লাম। সবাই বেশ ভালো এবং গুছিয়ে পোস্ট করেছে।
তাদের পোস্ট পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গেলাম প্রাচীন গ্রিসে।
পীথাগোরাস, এরিস্টটল, তারও আগে সক্রেটিস, এই ব্যাপারগুলোকে আলোচনা করে গেছেন।
ফিজিওগনমি, ফ্রেনলজি, ক্রিমিনাল অ্যান্থ্রোপলজিতে বিশেষভাবে বিজ্ঞ এই ফেসবুক ক্রাইম ইনভেস্টিগেটিং ব্রাঞ্চকে ধন্যবাদ।

এখন আমি একটু আলোচনা করি।

অনেক দিন আগে, ১৮-১৯ শতকের দিকে, ফিজিওগনমি, ফ্রেনলজি বেশ আলোচইত, চর্চিত, এবং গ্রহণযোগ্য ছিলো।
ফিজিওগনমি হচ্ছে, মানুষের চেহারা দেখে, সে অপরাধী কিনা সেটা নির্নয় করতে পারার বিদ্যা, আর ফ্রেনলজি হচ্ছে, মানুষের মাথার সাইজ দেখে, অপরাধী কিনা সেটা যাচাই করতে পারার বিদ্যা।
আর ক্রিমিনাল অ্যান্থ্রোপলজি হচ্ছে, ক্রিমিনাল এর আচার আচরণ, তার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য এইসকল যাচাই বাচাই করে, ক্রিমিনাল, কেমন হয়, বা কেমন লোক ক্রিমিনাল হতে পারে সেই ব্যপারে জ্ঞান অর্জন করার বিষয়।
তো এই তিনটা থিওরিতে বিশেষ মিল হলো, অপরাধ প্রবণতার কারণ জানার ক্ষেত্রে, ব্যক্তির বায়োলজিক্যাল ব্যক্ষা।
মানে অপরাধীর শারীরিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনার ক্ষেত্রে, একটা পয়েন্টে এই থিওরিগুলো একমত পোষণ করে যে, “অপরাধী সাধারণ/নরমাল মানুষের চাইতে দেখতে ভিন্ন হয়”।

১৮৫৯ সালের দিকে একজন ডাক্তার ছিলেন, উনার নাম লম্ব্রসো। তো লম্ব্রসো ব্রো ইতালি আর্মিতে ডাক্তার হিসেবে ঢুকে ওখানে চার বছর গবেষণা করে একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন, যেটা ডারউইনের বিবর্তনবাদ থিওরির উপর বেইজ করে তৈরি হয়েছে।
সেই থিওরি উনাকে আব্বু অফ আধুনিক ক্রিমিনোলজি হিসেবে খেতাব এনে দিয়েছিলো।
তো লম্ব্রোসো বলতে চেয়েছেন, শারীরিক বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে ক্রিমিনাল চিনে নেয়া সম্ভব।
শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, মানে, চুল-চোখ-হাত-পা-মুখের আদল ইত্যাদি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, অপরাধীর এই বৈশিষ্ট্যগুলো নরমাল মানুষের চাইতে আলাদা হয়।
আবার আরেকটি কনসেপ্ট তিনি আলোচনা করেছিলেন, যাকে এটাভিজম বলে। এই কনসেপ্ট এর মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, মানুষের আচরণে, তার পূর্বজদের আচরণ বিদ্যমান।

এখন এই সকল থিওরি বিংশ শতাব্দীতেই বাতিল হয়ে গিয়েছিলো।
এই ফ্রেনলজিকে, ছদ্মবিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অনেক আগেই।
আর লম্ব্রসোর থিওরির যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তা চার্লস বাকম্যান গোরিং বলে গিয়েছেন, তার দ্যা ইংলিশ কনভিক্ট: এ স্ট্যাটিস্টিকেল স্টাডি বইয়ে।
ইনফ্যাক্ট লম্ব্রসোকে দেখলে আমাদের ফেসবুক ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ, একটা লুইচ্চা বদরাগী রোগ হিসেবে চিহ্নিত করবে, যে তার বউকে প্রতিদিন পিটায় আর যৌবনে দুই একটা রেইপ করেছে।

এরিক বার্ন যিনি একজন আমেরিকান সাইক্রিয়াট্রিস্ট , তিনি ট্রান্সেকশনাল এনালাইসিস নিয়ে মানব চরিত্র, আচার আচরণ নিয়ে যে থিওরি দেন, তাতে তিনি বলেছেন, সকল মানুষ জন্ম নেয় অল কারেক্ট পজিশন নিয়ে, পরিবেশ পরিস্থিতি, সামাজিক, ধর্মীয় নিয়ম, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট সব কিছুর দ্বারা তার পরিবর্তন ঘটে।

যাই হোক,
আমি কারো উইশফুল থিংকিং এ বাধা দিচ্ছি না। উইশফুল থিংকিং মানে, “কোন কিছু সত্য বলিয়া ভাবা, কেননা তাহাই মনের ইচ্ছা”

তো আপনারা ভাবতে থাকুন।
৩০% ঋত্বিক ঘটক হয়ে, ভাবুন ভাবা প্র্যাক্টিস করুন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.