গোলাম মোস্তফা:
পঞ্চান্ন পেরোনোর আগেই আজিজ সাহেব হার্টএটাকে মারা গেলেন। বুকের ব্যথা নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: আর ফিরলেন না।
মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী কানিজ ও দুটো ছেলে বাচ্চা রেখে গেলেন। আজিজ সাহেবের কাছের আর কেউ টরেন্টো শহরে বসবাস করেন কীনা তা জানা যায় নাই।
আজিজ সাহেব বাংলাদেশে পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বুয়েট থেকে পাশ করা। ক্যানাডায় আসার আগ পর্যন্ত সরকারের একটি দপ্তরের এক্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ভদ্রলোক ঘুষ খেতেন না বলে শোনা যায়। দুর্নীতিও করতেন এ রকম শোনা যায়নি। তবে আজিজ সাহেবের স্ত্রী একদিন জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী ক্যানাডায় এসেছিলেন মুলত: সৎভাবেজীবন যাপন করার জন্য। কানিজ ঢাকার একটি কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করেছিলেন।
ক্যানাডায় চাকরির পরিবেশ ভিন্ন। নিজের পেশায় চাকরি না পেয়ে আজিজ সাহেব ট্যাক্সি চালানো শুরু করেন। অনেক ইমিগ্রান্ট ডাক্তারও টরেন্টাতে ট্যাক্সি চালান। তবে ট্যাক্সি চালিয়েও আজিজ সাহেব ভাল রোজগার করতেন।
বাড়ি গাড়ি করেছিলেন। কিন্তু মনের মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তির জ্বালা সব সময় পুড়িয়ে মারতো ওনাকে। কোনো কাজই অসম্মানের নয়। এটা উনি বুঝতেন। কিন্তু তারপরেও মনকে সবসময় বুঝাতে পারতেন না। যেটা কীনা মাঝে মাঝে খুব চাপ তৈরি করতো তার মন ও শরীরে।
আজিজ সাহেবের মৃত্যুতে তার স্ত্রী কানিজ একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। দুটো বাচ্চা নিয়ে এখন উনি কী করবেন? তার নেই কোন চাকরি-বাকরির করার অভিজ্ঞতা। না বাংলাদেশে না ক্যানাডায়। বাড়ির মাসিক মর্টগেজই বা পরিশোধ করবেন কীভাবে? উপায়ান্তর না পেয়ে তিনি বাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন।
আজিজ সাহেবের স্ত্রী কানিজ ছেলেদের জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদেন।এরপর দিন যায়।
মাস যায়।
বছর পেরোয়।আজিজ সাহেবের ছেলে দুটো বড় হতে থাকে। সিঙ্গেল প্যারেন্টের তত্ত্বাবধানে।
এক সময় বড় ছেলে হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করলো। মা আর ঠিকমত দেখাশোনা করতে পারে না। বড় ছেলে কোথায় যায়, কী করে? বড় ছেলের প্রশ্ন: তারা কেন এতো গরীব? মাকে সারাক্ষণ এ প্রশ্ন করতেই থাকে। কানিজ কোন জবাব দিতে পারে না।
এক সময় বড় ছেলে বাসায় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আসা শুরু করে। মা নিষেধ করলেও মায়ের কথা শোনে না। সারক্ষণ ঘরের মধ্যে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে শুয়ে থাকে। ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। ঠিকমতো স্কুলে যায় না।
আজিজ সাহেবের স্ত্রী লক্ষ্য করলেন তার ছোট ছেলেটাও ইদানিং গাঁজা ধরেছে। বাসায় আসলে কাপড় চোপর দিয়ে গাজার গন্ধ পায় কানিজ।
ছোট ছেলেও গার্লফ্রেন্ড ধরেছে। সেও ঘন ঘন গার্লফ্রেন্ড পাল্টায়। মা আরো লক্ষ্য করলেন যে, কোন মেয়ে তার সাথে বেশিদিন থাকে না। বা তার ছেলেই হয়তো গার্লফ্রেন্ড ধরে রাখতে পারে না। প্রথম প্রথম আজিজ সাহেবের স্ত্রীর খুব কষ্ট হতো। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ছেলেদের অনৈসলামিক কায়কারবার মেনে নিতে কষ্ট হতো। কিন্তু কী আর করা। সময়ের প্রয়োজনে তিনি ছেলেদের এ বিষয়গুলো এখন মেনে নিয়েছেন। তিনি শুধু চান ছেলেগুলো একজন কাউকে নিয়ে থাকুক। তাও পাপ একটু কম হবে। কিন্তু তার ইচ্ছাতে তো সব কিছু চলে না।দুজনেরই পড়াশোনা এখন বন্ধ। মানে তারা দুজনেই হাইস্কুল ড্রপ আউট।
তারা ফ্যাক্টরিতে মাঝে মাঝে কাজ করে। আজিজ সাহেবের স্ত্রী ছেলেদের বাসা থেকে তাড়িয়েও দিতে পারেন না। এগুলো তার নাড়ী ছেঁড়া ধন। এই ছেলে দুটো ছাড়া তো আর এখানে তার আর কেউ আপনজন নেই।এগুলো সহ্য করেন তিনি। কাছেই ফাস্টফুডের একটি দোকানে কষ্ট করে কাজ করেন। মালিক নারী। কানিজকে খুব পছন্দ করেন। কারণ মালিক তার কর্মদক্ষতায় খুব খুশি। মালিক কানিজকে আরেকটি বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু কানিজ তা কানে তোলে না। আজিজ সাহেবকে তিনি কোনদিন ভুলতে পারবেন না। যত কষ্টই হোক। ছেলেরা তাকে বলে বিয়ে করতে। কিন্তু কানিজ তা কানে তোলে না।
অনেক কষ্টে কানিজ সংসার চালান। তার আশা বাচ্চাগুলো তবুও তার পাশে থাকুক।
কানিজের শরীর-মন ইদানিং কোনটটাই আর ভালো চলে না। জীবনে কোনো উচ্ছাস নেই।
যখন গভীরভাবে চিন্তা করেন তখন দেখেন ভবিষ্যতটা অন্ধকার। সামনে যেন কোন আলো নেই।
স্বামী নেই।
ছেলে দুটো কেমন যেন হয়ে গেছে।
কোন আশা নেই।
কোন ভরসা নেই।এরকম ভাবতে ভাবতে কানিজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি আর ক্যানাডায় থাকবেন না। বাংলাদেশে চলে যাবেন। কোনো এক ডিসেম্বরের শেষে সত্যি সত্যি ছেলেদের রেখে তিনি বাংলাদেশে চলে যান। বাংলাদেশে গিয়ে বাবার বাড়িতে থাকা শুরু করেন। মাস তিনেক পর তার অসুস্থ বাবা মারা যান। মা আগেই মারা গিয়েছিল।
বাবা মারা যাওয়ার পর পৈতৃক সম্পত্তি ভাইবোনদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। তিনিও বেশ কিছু নগদ টাকা পেয়ে যান। টাকাটা পাওয়ায় মনটা অনেকখানি ভাল হয়ে যায় কানিজের। ক্যানাডা থেকে এখন ছেলেরাও ঘন ঘন ফোন দিতে থাকে। তারা তাদের মাকে ফেরত যেতে বলে। ছেলেরা বোধ হয় মায়ের অভাবটা বুঝতে শুরু করে। তারা মায়ের কথা শুনবে বলে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে। কিন্তু আজিজ সাহেবের স্ত্রী নাছোরবান্দা। তিনি আর কখনোই ফিরবেন না। ছেলেরা যত অনুরোধ করুক না কেন?
আরো মাস খানেক পরের কথা।
রোজার ঈদের কয়েকদিন পরে হবে হয়তো। কোন এক সকালে কলিং বেলের আওয়াজে আজিজ সাহেবের স্ত্রীর ঘুম ভাঙ্গে। দরজা খুলে দেখেন তার দুছেলে দরজায় দাঁড়ানো। তিনি তো তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না।
মাকে জড়িয়ে ধরে দুছেলে। অনেকক্ষণ কান্নাকাটি হয় মা-ছেলেদের মধ্যে।কানিজের মন গলে যায়। একমাস পরে তিনজনই টরোন্টোতে ফিরে আসে।
আজিজ সাহেবের স্ত্রী আগে যে ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ করতেন একদিন সেখানে যায় জবের খোঁজে।
মালিক জানায় এখন কোন জব নেই। কারণ তিনি দোকানটা বিক্রি করে দেবেন। তবে কানিজ দোকানটি কিনতে চাইলে দোকানটি সে কিনতে পারে। পুরাতন কর্মী হিসেবে বেশ কম দামেই সে কিনতে পারবে।
এ অফার পেয়ে কানিজ একটু চিন্তায় পড়ে যায়। কী করবে সে? তবু তিনি মালিককে জানালেন যে আগামীকাল চিন্তা করে এসে তাকে জানাবেন।রাতে ছেলেদের সাথে পরামর্শ করলেন। ছেলেরা কেনার পক্ষে সায় দিল।
পরের দিন দুছেলেকে সাথে নিয়ে গেলেন মালিকের কাছে। দোকান কেনা পাকাপোক্ত হলো। বায়না হলো। দেশ থেকে যে টাকা তিনি এনেছিলেন তাতে কাভার হলো না। ব্যাংক থেকে লাইন অব ক্রেডিট নেয়া ছিল তার স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায়। সেখান থেকে লোন নিয়ে দোকানের দাম পরিশোধ করে দিলেন। মালিকানা চেঞ্জ হতে আরো সপ্তাহ খানেক লেগে গেল।
আজিজ সাহেবের স্ত্রীর নামে দোকানের নামকরণ করা হলো: “কানিজ ফুডস্ কর্নার”। স্থানীয় বিজনেস ডিরেক্টরিতে কানিজ ফুডস্ এর নাম ঠিকানা সংযোজন করা হলো। কয়েকদিন এক নাগাড়ে সোশাল মেডিয়াতে পেইড প্রচার করা হলো। ওয়েবসাইটে তৈরি করে খাবারের দাম ও মেন্যু ও ছবি প্রকাশ করা হলো। অনলাইনে অর্ডারের ব্যবস্থা রাখা হলো। কানিজের ছোট ছেলে বিজনেস প্রমোশনে কাজ করে, আর গাড়ি দিয়ে খাবার হোম ডেলিভারি দেয়। বড় ছেলে অর্ডার নেয় আর খাবার তৈরি করে। কানিজ বিল নেন। আর সর্বোপরি দেখাশোনা করেন।
দোকানে নতুন নতুন আইটেম হতে লাগলো। দোকানে প্রচুর কাস্টমার। দুজন স্টাফও নিয়োগ দেয়া হলো।ছয় মাসের মধ্যে কানিজ ফুডস্ রাতারাতি পরিচিত হয়ে গেল। লাইন অব ক্রেডিটের লোন পরিশোধ করে ফেললো কানিজ সহজেই। কেউ কেউ ফ্রাঞ্চাইজও কিনতে চায় এখন।
আজিজ সাহেবের স্ত্রীর এখন নতুন দিন। ছেলেরা কর্মঠ। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। গার্লফ্রেন্ড নাই কারোরই এখন। বড় ছেলে ইদানিং বলে বাংলাদেশের একজন মেয়েকে বিয়ে করে ঘর বাঁধবেন।
ছোট ছেলে আবার স্কুলে যেতে চায়।কানিজ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখে।
গোলাম মোস্তফা, টরোন্টো।