শীলা মোস্তাফা:
সেদিন ঘরের পিছনের দরজা খুলে দিতেই দেখলাম একটা মৌমাছি উড়ে এসে মেঝেতে পড়ে গেল। ভাবলাম একটু পরে উড়ে চলে যাবে। দরজাটা খুলেই রাখলাম। ঘুরে এসে দেখলাম যেখানে পড়েছিল সেখানেই পড়ে আছে। আমি আমার ছেলেকে বললাম এটাকে বাইরে ছেড়ে দাও। বল্লো
-না মা এখন ওকে বাইরে ছেড়ে দিলে ও মরে যাবে। আমি হতভম্ব,
–মরবে কেন?
-ও মধুর খোঁজে উড়তে উড়তে দুর্বল হয়ে এখানে এসে পড়ে আছে। ও খুব ক্ষুধার্ত।
-তো আমি কি করবো! ওকি আমাদের ভাত তরকারি খাবে?
-না মা! আমি ওর খাওয়া তৈরি করছি।
তারপর আমার ছেলে পানিতে চিনি গুলিয়ে, তাতে ওকে বসিয়ে বারান্দায় রেখে এলো। আর বল্লো আমাদের এখন থেকে চিনি পানি গুলিয়ে বাইরে রেখে দিতে হবে। চিনির পানি খেয়ে মৌমাছি এক সময় সুস্থ হয়ে উড়ে গেছে। মনে মনে ভাবলাম এই ছেলে তো আমি জন্ম দেয়নি। আমি টিকটিকি ভয় পেতাম বলে আমাদের গৃহ সেবাকর্মীরা টিকটিকি লাঠি নিয়ে দৌড়াতো, হয়তো মেরেও ফেলতো। আমি টিকটিকি মুক্ত ঘরে আনন্দ দিন কাটাতাম।
অস্ট্রেলিয়ায় আগুনের দাবানলে বন্যপ্রাণীর অসহায় মৃত্যুতে শোকাহত বাংলাদেশের আপামর জনতা। ফেসবুক সয়লাব হয়ে গেছে তাদের শোক পোস্টে। তাদের কেউ ছাত্র, কেউ গৃহবধূ, কেউ বাড়িওয়ালা, কেউ দারোয়ান, কেউ পথচারী, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সরকারি আমলা, কেউ পুলিশ, কেউবা শিক্ষক, কেউ মাদ্রাসার ছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা। সকলেই ভয়াবহতার চিত্র দেখে মর্মাহত। সকলেই মনের একই আকুতি, “আমি যদি কাছে থাকতাম একটু সাহায্য করতে পারতাম।”
হায় প্রদীপের নিচে অন্ধকার। এই শহরেই অসহায় মা কুকুর থেকে টেনে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয় নবজাতক শিশু কুকুরদের। সঙ্গমরত কুকুরের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়া হয়। চায়ের দোকানদার গরম পানি ঢেলে দেয় ক্ষুধার্ত কুকুরের গায়ে। একজন বাড়িওয়ালা পিটিয়ে হত্যা করেন তার দরজায় আসা শীতে কাতর আশ্রয়প্রার্থী একটি কুকুরকে। এই শহরে মুখ ভেঙে দেয়া হয় কুকুরকে ইট মেরে। এই শহরেই বস্তায় ভরে কুকুর-বিড়ালকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়। মোটরসাইকেল চালিয়ে দেয়া হয় তাদের উপর দিয়ে। ছোট কোমলমতি বাচ্চাদের নিয়ে বিড়ালকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং তা ফেসবুকের লাইক দিয়ে আনন্দ উৎসব করা হয়। এই শহরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কুকুর মেরে স্তুপ করে রাখা হয়, কোনে ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবাদ করে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের কথা নাই বললাম। এইসব বিদ্যাপীঠই এই আমাদের মানুষ হওয়ার মন্ত্র শেখায়।
রাস্তায় নিরীহ কুকুররা হেঁটে বেড়ায়, একটু আশ্রয়ের জন্য খাদ্যের জন্য। তাদের অকারণেই ইট ছোঁড়া হয় লাথি মারা হয়। কেউ প্রতিবাদ করে না। কিন্তু উল্টো যদি কুকুর আত্মরক্ষার জন্য কামড় দেয়, তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের উপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলে, বিচার তো দূরের কথা চিকিৎসা হয় না। কুকুর-বিড়ালের জীবনের কোন দাম নেই। এরকম একটা নির্দয় দেশের মানুষ কী করে অস্ট্রেলিয়ার বন্য প্রাণীর জন্য কান্নাকাটি করে?
আমাদের সকল সমাজসেবা, আমাদের বুদ্ধিমত্তার চর্চা, আমাদের আধুনিকতা, আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতা, আমাদের জীব প্রেম সোশ্যাল মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ।
“ছোটবেলায় আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে টিকটিকি মারলে ছোয়াব হয়, মাকড়সা মারলে গুনা হয়।” সে কুসংস্কারচ্ছন্ন মগজ ধোলাই থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারিনি। এখনও নির্মম হন্তারকের মত টিকটিকি মারলে কোনই গায়ে লাগে না, বেহেশতে যাবার লোভে মাকড়সা আদর করে বাইরে ছেড়ে দেই। এই শহরেই বাড়িওয়ালা তার বাড়িতে কুকুর রাখতে দেবে না, মা তার সন্তানকে শেখাবে কুকুর নাপাক, তাকে বাড়িতে জায়গা দেয়া যাবে না। মাদ্রাসার শিক্ষক ছাত্রকে শিক্ষা দেয়া কুকুরকে যত মারবে, তত সোয়াব হবে।
আমাদের গোড়াতেই গলদ। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আদর স্নেহ মমতা লালন করার পরিবেশ তৈরি করা হয় না। আমাদের ভালবাসার সীমাবদ্ধ আমাদের পরিবারের মধ্যে বন্ধু আত্মীয় স্বজনের মধ্যে। রাস্তায় অপরিচিত মানুষকে যে ভালোবাসা যায়, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া যায়, তার প্রতি মমতার হাত বাড়িয়ে দেয়া যায় তা শেখানো হয় না, পশু পাখির প্রতি মমতা তো দূরের কথা।
আমি আমার দশ বছরের সন্তানকে ভালোবাসি, কিন্তু আমার ঘরে দশ বছরের একটি ছেলে কাজ করে। সমাজ সংসার এবং সরকারের মতো ওই দশ বছরের ছেলেটির প্রতি আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই। এমনকি অনাত্মীয় দূরের গরিবদের সাহায্য করতে চাইলে নিজের কাছের মানুষরাই বলবে, “আরে নিজেদের আত্মীয়দের মধ্যেই তো কত গরিব আছে, তাদের সাহায্য করো।”
আমরা বিনা কারণে কাউকে ভালোবাসতে জানি না। সাহায্য করলেও তা ধর্মের কারণে, সেই বেঁধে দেয়ার নিয়ম অনুযায়ী সাহায্য করতে হবে। কোটি মানুষের দেশে আমরা শুধু পাশে কাটিয়ে বাঁচতে চাই, বেঁচে আছি। অসুস্থ নোংরা কুকুর কিংবা মানুষ দেখলে আমার নাক চেপে দূরে সরে যাই। সরকারের মতো আমাদেরও কোন মাথা ব্যথা নেই।
এলিসো ভিহেয়ো
ক্যালিফোর্নিয়া